সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

সেনাপতির নির্দেশ


true story:সত্য গল্প, 
সেনাপতির নির্দেশ
(www.kishorkanthabd.com/ মাসিক কিশোরকন্ঠ থেকে সংগৃহীত)


অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।
চারপাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠছে।
ঠিক এমনই সময়।
এমনই সময় হজরত হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান মুসলমান হন। মক্কায়, ইসলামের প্রথম পর্বে। পিতার সাথে মা-ও ইসলাম গ্রহণ করেন।
কী এক বিস্ময়কর ব্যাপার!
পুলকিত ও শিহরিত আকাশ-বাতাস।
ভাগ্যবান হুজাইফা! তিনি ক্রমশ বেড়ে ওঠেন মুসলিম পিতা-মাতার কোলে।
আরও মজার ব্যাপার যে রাসূলে কারীমকে (সা) দেখার সৌভাগ্য অর্জনের আগেই তিনি মুসলিম হন। ভাই-বোনের মধ্যে শুধু তিনি ও সাফওয়ান এ গৌরবের অধিকারী হন।
মুসলিম হওয়ার পর রাসূলকে (সা) একটু দেখার আগ্রহ জন্মে তার। দারুণ আগ্রহ! দিন দিন তার মধ্যে এ আগ্রহ তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হতে থাকে। তিনি সব সময় যারা রাসূলকে (সা) দেখেছেন, তাঁদের কাছে রাসূলের (সা) চেহারা-সুরত ও গুণ-বৈশিষ্ট্য কেমন তা জানার জন্য প্রশ্ন করতেন।
শেষে তিনি একদিন সত্যি সত্যি মক্কায় রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে হাজির হন এবং হিজরত ও নুসরাতের ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চান। রাসূল (সা) তাঁকে দুটোর যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দান করেন।
হুজাইফা বলেন : রাসূল (সা) হিজরাত ও নুসরাত (মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে অবস্থান)-এর যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আমাকে দান করেন। আমি পরম আনন্দের সাথে নুসরাতকে বেছে নিলাম।
মক্কার প্রথম সাক্ষাতে তিনি প্রশ্ন করেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি মুহাজির না আনসার?
রাসূল (সা) জবাব দিলেন : তুমি মুহাজির বা আনসার যে কোন একটি বেছে নিতে পার।
তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনসারই হবো।
হযরত হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন।
পিতা ও পুত্র একই সাথে যুদ্ধ করছেন!
হুজাইফা দারুণ সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদিনায় ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ সাহসী পিতা যুদ্ধের ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন! আর সে শাহাদাত ছিল স্বপক্ষীয় মুসলিম সৈনিকদের হাতে।
ঘটনাটি ছিল একটু অন্যরকম। যেমনÑ
উহুদ যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এ দুই বৃদ্ধকে রাখা হয় ঐ দুর্গের তত্ত্বাবধানে।
যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করলো, তখন আল-ইয়াসান তার সাথী সাবিতকে বললেন : তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মতো আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে এসেছে। আমরা খুব বেশি হলে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি উচিত নয়, তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট চলে যাওয়া? হতে পারে, আল্লাহ তাঁর নবীর (সা) সাথে আমাদের শাহাদাত দান করবেন। তখন তাঁরা দুজন তরবারি হাতে নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।
এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী পরাজয় বরণ করে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছিল। তখন এক দুরাচারী শয়তান চেঁচিয়ে বলে ওঠে, দেখ দেখ, মুসলমানরা এসে পড়েছে!
একথা শুনেই পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে দাঁড়ায় এবং মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও সাবিত দুদলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান।
পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে সাবিত শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে। না চেনার কারণে এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়।
হুজাইফা কিছু দূর থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেন :
আমার আব্বা, আমার আব্বাবলে।
কিন্তু সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতোমধ্যে বৃদ্ধ নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়ে গেছেন।
হুজাইফা পিতার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেন: আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।
কী অসাধারণ ধৈর্য ও সাহস! কী অসম্ভব মনের জোর! ঈমানী শিক্ষার কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত!
রাসূলে কারীম (সা) হুজাইফাকে তাঁর পিতার দিয়াত বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি বললেন : আমার আব্বা তো শাহাদাতেরই প্রত্যাশী ছিলেন। তিনি সেটা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে দিলাম।
হুজাইফার এই সাহসী উচ্চারণে রাসূল (সা) দারুণ খুশি হলেন।
হজরত হুজাইফা খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের ময়দানে কুরাইশরা এমন তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদিনায় ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে।
মদিনার চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশ বাহিনীর লোকেরা ছড়িয়ে গেছে।
রাসূল (সা) আল্লাহর কাছে দুয়া করেন, আর সেই সাথে মদিনার প্রতিরক্ষার জন্য খন্দক খনন করেন।
এক রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল! সেটা ছিল মুসলমানদের জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে। কুরাইশরা মদিনার আশপাশের বাগানগুলোতে শিবির স্থাপন করে আছে। হঠাৎ প্রচণ্ড এমন এক বাতাস বইতে শুরু করলো যে, কুরাইশদের তাঁবু রশি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল। এবং হাড় কাঁপানো শীত শুরু হলো।
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বললো, আর উপায় নেই! এখনই এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। জলদি পালাতে হবে। আর দেরি নয়। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়!
হজরত রাসূলে কারীম (সা) কুরাইশ বাহিনী নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি সেই ভয়াল দুর্যোগময় রাতে হুজাইফার শক্তি ও অভিজ্ঞতার সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলেন। তিনি কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইচ্ছা করলেন।
আর এ দুঃসাহসী অভিযানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত হুজাইফাকে নির্বাচন করলেন। রাসূল (সা) সঙ্গীদের বললেন : যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি কিয়ামতের দিন আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি।
একে তো দারুণ শীত, তার ওপর প্রবল বাতাস! কেউ সাহস পেল না।
রাসূল (সা) তিনবার হুজাইফার নাম ধরে ডেকে বললেন : তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।
যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন, সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া হুজাইফার আর কোনো উপায় ছিল না। এ সম্পর্কে হুজাইফা নিজেই বলেন : আমরা সে রাতে কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম।
আবু সুফিয়ান ও মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের ওপরের দিকে, আর নিচে ছিল বনি কুরাইজার ইহুদি গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেই সাথে ছিল প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন দুর্যোগপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার শব্দের মত তীব্র। আর এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বলতে লাগলো : আমাদের ঘরদোর শত্রর সামনে একেবারেই খোলা। তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমিত চাই।
মূলত অবস্থা সে রকম ছিল না। কেউ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেই রাসূল (সা) অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শো বা তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।
এমন এক সময় রাসূল (সা) এক এক করে আমাদের সবার কাছে আসতে লাগলেন।
এক সময় আমার কাছেও এলেন।
শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। চারদটি ছিল আমার স্ত্রীর, আর তা খুব টেনেটুনে হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল।
রাসূল (সা) আমার একেবারে কাছে এলেন।
আমি মাটিতে বসেছিলাম। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন : এই তুমি কে?
বললাম : আমি হুজাইফা।
তুমি হুজাইফা? এই বলে রাসূল (সা) মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই।
আমি বললাম : হাঁ , ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি হুজাইফা।
তিনি বললেন : তুমি কুরাইশদের শিবিরে গিয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দেবে।
আমি বের হলাম। সেনাপতির নির্দেশ বলে কথা! অথচ আমি ছিলাম সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল (সা) দুআ করলেন : হে আল্লাহ! সামনে-পেছনে, ডানে-বামে, ওপর-নিচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাজত কর। রাসূলাল্লাহর (সা) এ দুআ শেষ না হতেই আমার মনের সকল ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেল এবং কী আশ্চর্য! শীতের জড়তাও কেটে গেল। আমি যখন পেছন ফিরে চলতে শুরু করেছি তখন রাসূল (সা) আমাকে আবার ডেকে বললেন : হুজাইফা! আমার কাছে ফিরে না এসে আক্রমণ করবে না।
বললাম : ঠিক আছে। আমি রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে চলতে লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন। আমার পৌঁছার কিছুক্ষণ পর আবু সুফিয়ান কুরাইশ বাহিনীর সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তা মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কি না। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ। এ কথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুঠ করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম : কে তুমি?
সে জবাব দিল, আমি অমুকের ছেলে অমুক।
আবু সুফিয়ান বললেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে নও। আমাদের ঘোড়াগুলো মরে গেছে, উটগুলো কমে গেছে এবং মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজাও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে এসেছে তা সুখকর নয়। আর কেমন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছো। আমাদের হাঁড়িও আর নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছে না। সুতরাং ফিরে চলো। আমি চলছি।
এ কথা বলে তিনি উটের রশি খুললেন এবং তার পিঠে চড়ে বসে উটের গায়ে আঘাত করলেন। উট চলতে শুরু করলো। কোন কিছু ঘটাতে রাসূল (সা) যদি নিষেধ না করতেন তাহলে একটি মাত্র তীর মেরে তাকে হত্যা করতে পারতাম।
আমি ফিরে এলাম। এসে দেখলাম রাসূল (সা) তাঁর এক স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন। নামাজ শেষ করে তিনি আমাকে তাঁর দুপায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি সব খবর তাঁকে জানালাম।
তিনি দারুণ খুশি হলেন এবং আল্লাহর হামদ ও ছানা পেশ করলেন।
হজরত হুজাইফা সে দিন বাকি রাতটুকু রাসূলুল্লাহর (সা) সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে সেখানেই রাত কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল (সা) তাঁকে ডাকেন : ইয়া নাওমান-হে ঘুমন্ত ব্যক্তি! কী সৌভাগ্যবান হজরত হুজাইফা!
এখানেই শেষ নয়। আরো আছে তাঁর সাহসের কথা। আছে এমনতর অনেক প্রসঙ্গ। সেখানেও রয়ে গেছে হুজাইফার ঈমান ও সাহসের অজস্র সাম্পান। সে সম্পর্কেও আমরা জানবো আগামীতে। জানতে হবে আমাদের বড় হওয়ার জন্য। সাহসী হওয়ার জন্য।
নিজেদের গড়ে ওঠার জন্য।



ভালোবাসার বিশাল আকাশ


true story:সত্য গল্প, 
ভালোবাসার বিশাল আকাশ
কায়েস মাহমুদ
(www.kishorkanthabd.com/ মাসিক কিশোরকন্ঠ থেকে সংগৃহীত)


আমাদের রাসূল (সা)।
প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা) ছিলেন একেবারেই এতিম।
এতিম ছিলেন বলেই তিনি বুঝতেন এতিম ও অসহায়দের মনের কষ্ট।
জীবনের কষ্ট।
কাজের কষ্ট।
তাদের সকল কষ্টই তিনি অনুভব করতেন একান্ত হৃদয় দিয়ে।
ফলে তাদের সেসব কষ্টের তুষার দূর করার জন্য রাসূল (সা) সকল সময় থাকতেন ব্যাকুল।
তাদের প্রতি ছিল তাঁর বিশাল হৃদয়।
আকাশের মতো, তার চেয়েও বিশাল।
বিশাল ছিলো তাঁর মন ও ভালোবাসার দরিয়া। সেখান থেকে উঠে আসতো দরদের তুফান। মমতার ঢেউ।
সেই ঢেউ আছড়ে পড়তো নবীর (সা) চারপাশে। সকলের হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে যেত রাসূলের (সা) ভালোবাসার কোমল তুষারে।
মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাসেতো এক মহৎ গুণ!
মানুষকে ভালোবাসতেন রাসূল (সা) মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, জীবন দিয়ে।
কিন্তু এতিম, গরিব, দুস্থ এবং অসহায়দের প্রতি রাসূলের (সা) ভালোবাসার মাত্রাটা ছিল অনেক-অনেক গুণে বেশি।
যার কোনো তুলনাই হয় না।
সেই ভালোবাসার নজির তো রয়ে গেছে রাসূলের (সা) জীবনেই।
তাঁর জীবন-ইতিহাসের পাতায় পাতায়। লাইনে লাইনে। অক্ষরে অক্ষরে।
সে সবই আমাদের জন্য হীরকসমান। আলোকসমান।
তা যেমন শিক্ষণীয় তেমনই পালনীয়।
এতো আমাদের সকলেরই জানা। তবুও আর একবার স্মরণ করি সেই এক ঈদের কথা!
ঈদ মানেই তো খুশি আর খুশি। আনন্দের ঢল।
সবার জন্যই চাই ঈদের আনন্দ। সমান খুশি। কিন্তু চাইলেই কি সব হয়? কিছু ব্যতিক্রম তো থেকেই যায়।
যেমন রাসূলের (সা) সময়ে এক ঈদে, নামাজ শেষে ঘরে ফিরছেন দয়ার নবীজী (সা)। তিনি দেখলেন মাঠের এক কোণে বসে কাঁদছে একটি তুলতুলে কোমল শিশু।
এই খুশির দিনেও কান্না! অবাক হলেন রাসূল (সা)।
তাঁর হৃদয়ের বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়লো।
রাসূল (সা) ছেলেটির কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
শিশুটি বললো, আমার আব্বা-আম্মা নেই। কেউ আমাকে আদর করে না। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আমি কোথায় যাবো?
এতিম নবী রাহমাতুল্লি­ল আলামিন।
ছেলেটির কথা শুনে গুমরে কেঁদে উঠলো নবীজীর (সা) কোমল হৃদয়। জেগে উঠলো তাঁর মর্মবেদনা। তিনি পরম আদরে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
হযরত আয়েশাকে (রা) ডেকে বললেন,
হে আয়েশা! ঈদের দিনে তোমার জন্য একটি উপহার নিয়ে এসেছি। এই নাও তোমার উপহার। ছেলেটিকে পেয়ে দারুণ খুশি হলেন হযরত আয়েশা (রা)। দেরি না করে মুহূর্তেই তাকে গোসল করিয়ে জামা পরালেন। তারপর তাকে পেট ভরে খেতে দিলেন।
রাসূল (সা) ছেলেটিকে বললেন, আজ থেকে আমরাই তোমার পিতা-মাতা। আমরাই তোমার অভিভাবক। কি, খুশি তো!
রাসূলের (সা) কথা শুনে ছেলেটির চোখেমুখে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা।
এই ছিল এতিমের প্রতি রাসূলের (সা) ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত!
রাসূল (সা) শুধু এতিমদের প্রতিই যে এমন সদয় ছিলেন, সহমর্মী ছিলেন তাই নয় তিনি তাঁর অধীনস্থদের প্রতিও ছিলেন সদা সজাগ ও দরদি।
মায়া-মমতার চাদরে তাদেরকে আঁকড়ে রাখতেন।
তাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, মনে যেন কোনোপ্রকার দুঃখ না থাকে দয়ার নবী (সা) সেদিকে খেয়াল রাখতেন সর্বক্ষণ।
রাসূলের (সা) দুজন খাদেম বা চাকর ছিলেন। একজন হযরত যাইদ ও আর একজন হযরত আনাস (রা)।
তাদের সাথে রাসূল (সা) কখনোই মনিবসুলভ আচরণ করতেন না।
কড়া ভাষায় কথা বলতেন না।
খারাপ ব্যবহার করতেন না।
মেজাজ দেখাতেন না।
আদেশ কিংবা নির্দেশে কঠোরতাও দেখাতেন না।
বরং আপন পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের সাথে ব্যবহার করতেন।
একই খাবার খেতেন।
একই ধরনের জীবন-যাপন করতেন।
কী আশ্চর্যের ব্যাপার!
আজকের দিনে যা কল্পনাও করা যায় না।
হযরত যাইদের (রা) কথাই বলি না কেন!
ছোট্টবেলায় তিনি মা-বাপ থেকে হারিয়ে যান।
আল্লাহর রহমতে তার আশ্রয় হয় রাসূলের (সা) ঘরে।
যখন তার পিতা-মাতার সন্ধান পাওয়া গেল, তখন তারা ছুটে এলো রাসূলের (সা) কাছে।
তারা তাকে নিয়ে যেতে চায়।
রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তোমার পিতা-মাতার সাথে যাবে?
যাইদ (রা) সাথে সাথেই বললেন, রাসূলের (সা) কাছ থেকে যে ব্যবহার আমি পেয়েছি, তাঁর কোনো তুলনা হয় না। তামাম পৃথিবী যদি আমাকে দেয়া হয় তবুও তাঁকে ছেড়ে আমি যেতে পারবো না।
না, কখনোই যাবো না।
হযরত আনাস (রা)।
তিনি আট বছর বয়সে রাসূলের (সা) খেদমতে এসেছিলেন।
দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত রাসূলের (সা) খেদমত করেছিলেন।
সেই হযরত আনাস (রা) বলেন,
দীর্ঘ দশ বছর রাসূলের (সা) খেদমত করেছি। কিন্তু এই দশ বছরের মধ্যে কোন একটি দিনও রাসূল (সা) আমাকে একটি কথাও ধমক দিয়ে বলেননি।
এমনই ছিল রাসূলের (সা) আচার-ব্যবহার।
এমনই ছিল তাদের প্রতি তাঁর হৃদয়ের ভালোবাসা।
এমনই ছিল তাঁর উদারতা। ছিল দয়া ও মমতার অসীম সাগর।
সাগরের চেয়েও অধিক।
রাসূলের (সা) মতো এমনই হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে আমাদের।
যে হৃদয় হবে ভালোবাসায় পূর্ণ। মমতায় টইটম্বুর।
যে হৃদয় হবে আকাশের চেয়েও প্রশস্ত। সাগরের চেয়েও বিশাল।
এমনই হৃদয় তৈরির জন্য প্রয়োজন রাসূলের (সা) শিক্ষা গ্রহণ ও সৎ সাহসের।
এ জন্যই আমাদের রাসূলের (সা) আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।
তাঁর পথেই চলতে হবে।
তাঁর শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে।
তাহলেই কেবল সুন্দর, সার্থক ও সফল হবে আমাদের জীবন।
এসো, আমরা রাসূলকে (সা) ভালোবাসি।
তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করি।
তাঁর আদর্শ অনুসরণ করি। তাঁরই দেখানো আলো ঝলমলে পথে সর্বদা চলি।

বয়ে যায় নিরন্তর


true story:সত্য গল্প, 
বয়ে যায় নিরন্তর
কায়েস মাহমুদ
(www.kishorkanthabd.com/ মাসিক কিশোরকন্ঠ থেকে সংগৃহীত)



মানুষ হিসাবে যারা বড়, তাঁদের কথাই আলাদা।
হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ হয় না তাঁদের জীবন-আলেখ্য।
শেষ হয় না লিখে তাঁদের বহু বর্ণিল জীবনের ইতিহাস।
তখনও বাকি থেকে যায় অনেক কিছু। অনেক কথা। অনেক ইতিহাস।
যেমন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা।
মস্ত বড় এক সাহসী মানুষ। বিশাল তাঁর জীবন-ইতিহাস।
আজকে জানবো এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে আরও কিছু বিষয়-আশয়।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা একবার উসাইরের সাথে দেখা করে বলেন,
যদি আপনি নিরাপত্তার আশ্বাস দেন তাহলে একটি কথা বলি।
সে আশ্বাস দিল।
আবদুল্লাহ বলেন : রাসূলুল্লাহ [সা] আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আপনাকে খাইবারের নেতা বানানো তাঁর ইচ্ছা। তবে আপনাকে একবার মদিনায় যেতে হবে।
সে প্রলোভনে পড়ে এবং তিরিশ জন ইহুদিকে সঙ্গে করে আবদুল্লাহর বাহিনীর সাথে চলতে শুরু করলো।
পথে আবদুল্লাহ প্রত্যেক ইহুদির প্রতি নজর রাখার জন্য একজন করে মুসলিম নির্দিষ্ট করে দিলেন। এতে উসাইরের মনে সন্দেহের উদ্রেক হল এবং ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
ধোঁকা ও প্রতারণার অপরাধে মুসলিম মুজাহিদরা খুব দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে তাদের সকলকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর খাইবারের মাথাচাড়া দেয়া বিদ্রোহ দমিত হয়।
পরে হজরত রাসূলুল্লাহ [সা] আবদুল্লাহকে খাইবারে উৎপাদিত খেজুর পরিমাপকারী হিসেবে আবারও সেখানে পাঠান।
কিছু লোক রাসূলুল্লাহর [সা] নিকট আবদুল্লাহর কঠোরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো।
এক পর্যায়ে তারা ঘুষও দিতে চাইল।
ইবন রাওয়াহা তাদেরকে বললেন : হে আল্লাহর দুশমনরা! তোমরা আমাকে হারাম খাওয়াতে চাও? আমার প্রিয় ব্যক্তির পক্ষ থেকে আমি এসেছি।
আমার নিকট তোমরা বানর ও শূকর থেকেও ঘৃণিত।
তোমাদের প্রতি ঘৃণা এবং রাসূলের [সা] প্রতি ভালোবাসা তোমাদের ওপর কোন রকম জুলুলের দিকে নিয়ে যাবে না।
এ কথা শুনে তারা বলল : এমন ন্যায়পরায়ণতার ওপরই আসমান ও জমিন প্রতিষ্ঠিত।
হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুযায়ী সে বছরের মুলতবি উমরাহ রাসূল [সা] পরের বছর হিজরি সপ্তম সনে আদায় করেন।
একে উমরাতুল কাদা বা কাজা উমরা বলে।
এই সফরে রাসূলে কারীম [সা] যখন মক্কায় প্রবেশ করেন এবং উটের পিঠে বসে হাজরে আসাওয়াদ চুম্বন করেন তখন আবদুল্লাহ তার বাহনের লাগাম ধরে একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। কবিতাটির কিছু অংশের মর্ম নিম্নরূপ :
ওরে কাফিরের সন্তানরা ! তোরা তাঁর পথ থেকে সরে যা, তোরা পথ ছেড়ে দে। কারণ, সকল সৎকাজ তো তাঁরই সাথে। আমরা তোদের মেরেছি কুরআনের ব্যাখ্যার ওপর, যেমন মেরেছি তার নাজিলের ওপর। এমন মার দিয়েছি যে, তোদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্ধু ভুলে ফেলে গেছে তাঁর বন্ধুকে। প্রভু আমি তাঁর কথার ওপর ঈমান এনেছি।
কবি বলে কথা!
কবি বলেই তিনি এমন সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পেরেছিলেন।
ঈমানদার সাহসী কবিরা তো এমনই হন।
এক সময় হজরত উমার [রা] ধমক দিয়ে বলেন : আল্লাহর হারামে ও রাসূলের [সা] সামনে এভাবে কবিতা পাঠ?
রাসূল [সা] তাঁকে শান্ত করে বলেন : উমার! আমি তার কথা শুনছি। আল্লাহর কসম! কাফিরদের ওপর তার কথা তীর বর্শার চেয়েও বেশি ক্রিয়াশীল।
তিনি আবদুল্লাহকে বলেন : তুমি এভাবে বল : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, নাসারা আবদাহ ওয়া আয়ায্যা জুনদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহ-
এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছেন এবং একাই প্রতিপক্ষের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা উপরোক্ত বাক্যগুলি আবৃত্তি করছিলেন, আর তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করছিলেন সমবেত মুসলিম জনমণ্ডলী। তখন মক্কার উপত্যকাসমূহে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছিল।
সে এক অবাক কাণ্ড!
হিজরি অষ্টম সনের জামাদি-উল-আউয়াল মাসে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
রাসূলুল্লাহ [সা] বসরার শাসকের নিকট দূত মারফত একটি চিঠি পাঠান।
পথে মুতা নামক স্থানে এক গাসসানী ব্যক্তির হাতে দূত নিহত হয়।
দূতের হত্যা মূলত যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত।
রাসূল [সা] খবর পেয়ে যায়িদ ইবন হারিসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী মুতায় পাঠান।
যাত্রার প্রাক্কালে হজরত রাসূলে কারীম [সা] বলেন : যায়িদ হবে এ বাহিনীর প্রধান। সে নিহত হলে জাফর ইবন আবি তালিব তার স্থলাভিষিক্ত হবে। জাফরের পর বাহিনীর প্রধান হবে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। আর সেও যদি নিহত হয় তাহলে মুসলমানরা আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের আমীর বানিয়ে নেবে।
বাহিনী মদিনা থেকে যাত্রার সময় হজরত রাসূলে কারীম [সা] সানিয়্যাতুল বিদা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তাদের বিদায় জানান।
বিদায় বেলা মদিনাবাসী তাদেরকে বলল : তোমরা নিরাপদে থাক এবং সফল হয়ে ফিরে এসো। আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা কাঁদতে লাগলেন।
লোকেরা বলল : কাঁদার কী আছে?
তিনি বললেন, দুনিয়ার মহব্বতে আমি কাঁদছি না।
তিনি সূরা মারইয়াম এর ৭১ নং আয়াতÑতোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করতে হবে। এটা তোমার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত-পাঠ করেন। তারপর তিনি বলেন, আমি কি সেই পুলসিরাত পার হতে পারবো?
লোকরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল : আল্লাহ তোমাকে রাসূলুল্লাহর [সা] সাথে আবার মিলিত করবেন।
তখন তিনি স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির অর্থ নিম্নরূপ:
তবে আমি রহমানের কাছে মাগফিরাত কামনা করি, আর কামনা করি তরবারির অন্তর্ভেদী একটি আঘাত, অথবা কলিজা ও নাড়িতে পৌঁছে যায় নিযার এমন একটি খোঁচা, আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী যেন বলেÑহায় আল্লাহ, সে কত ভালো যোদ্ধা ও গাজী ছিল।
মদিনা থেকে শামের মায়ান নামক স্থানে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন যে, রোমান সম্রাট হিরাকল এক লাখ রোমান সৈন্যসহ বালকা-র মাব নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে। আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে লাখম, জুজাম, কায়ন, বাহরা, বালী-সহ বিভিন্ন গোত্রের আরও এক লাখ লোক।
এ খবর পেয়ে তাঁরা মায়ানে দুই দিন ধরে চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করেন। মুসলিম সৈনিকদের কেউ কেউ মত প্রকাশ করে যে, আমরা শত্রপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ও প্রস্তুতির সব খবর রাসূলকে [সা] অবহিত করি। তারপর তিনি আমাদেরকে অতিরিক্ত সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন এবং আমরা সেই মুতাবিক কাজ করব।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তখন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তিনি বলেন,
হে জনমণ্ডলী, এখন তোমরা শত্রর মুখোমুখি হতে পছন্দ করছো না; অথচ তোমরা সবাই শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়েছো। আমরা তো শত্রর সাথে সংখ্যা, শক্তি ও আধিক্যের দ্বারা লড়বো না। আমরা লড়বো দীনের বলে বলীয়ান হয়ে-যে দীনের দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তোমরা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়। তোমাদের সামনে আছে দুটি কল্যাণের যে কোন একটিÑহয় বিজয়ী হবে নতুবা শাহাদাত লাভ করবে।
সৈনিকরা তাঁর কথায় সায় দিয়ে বলল : আল্লাহর কসম! ইবন রাওয়াহা ঠিক কথাই বলেছেন। তারা তাদের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাও একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তাদের সাথে চলেন।
তাঁরা মায়ান ত্যাগ করে মুতায় পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন।
এখানে অমুসলিমদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধ হয়।
ইতিহাসে এই যুদ্ধ মুতার যুদ্ধ নামে খ্যাত। মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা মাত্র তিন হাজার আর শত্রবাহিনীর সংখ্যা ছিল অগণিত।
প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো। সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলেন।
জাফর তাঁর পতাকাটি তুলে নিলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনিও শাহাদাত বরণ করলেন।
এবার আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ছিলেন ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার মুহূর্তে তাঁর মনে একটু দ্বিধার ভাব দেখা দিল। তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আপন মনে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। তার কিছু অংশ নিম্নরূপ :
হে আমার প্রাণ! আমি কসম করেছি, তুমি অবশ্যই নামবে, তুমি স্বেচ্ছায় নামবে অথবা নামতে বাধ্য করা হবে। মানুষের চিৎকার ও ক্রন্দন ধ্বনি উত্থিত হচ্ছেতোমার কী হয়েছে যে, এখনও জান্নাতকে অবজ্ঞা করছো? সেই কত দিন থেকে না এই জান্নাতের প্রত্যাশা করে আসছো, পুরনো ফুটো মশকের এক বিন্দু পানি ছাড়া তো তুমি আর কিছু নও। হে আমার প্রাণ, আজ তুমি যা কামনা করতে এখন তোমাকে তাই দেয়া হয়েছে, তুমি তোমার সঙ্গীদ্বয়ের কর্মপন্থা অনুসরণ করলে হিদায়াত পাবে।
উপরোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করতে করতে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন।
তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই গোশতসহ এক টুকরো হাড় নিয়ে এসে তার হাতে দেন। তিনি সেটা হাতে নিয়ে যেই না একটু চাটা দিয়েছেন, ঠিক তখনই প্রচণ্ড যুদ্ধের শোরগোল ভেসে এলো।
তুমি এখনও বেঁচে আছ’Ñএ কথা বলে হাতের হাড়টি ছুড়ে ফেলে তরবারি হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা।
শত্রপক্ষের এক সৈনিক এমন জোরে তীর নিক্ষেপ করে যে, মুসলিম বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। একটি তীর তাঁর দেহে বিদ্ধ হয়। তিনি রক্তরঞ্জিত অবস্থায় সাথীদের আহ্বান জানান। সাথীরা ছুটে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং শত্রবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
মুতায় অবস্থানকালে শাহাদাতের পূর্বে একদিন রাতে তিনি একটি মর্মস্পর্শী কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। আবৃত্তি শুনে যায়িদ ইবন আরকাম কাঁদতে শুরু করেন। তিনি যায়িদের মাথার ওপর দুররা উঁচু করে ধরে বলেন: তোমার কী হয়েছে? আল্লাহ আমাকে শাহাদাত দান করলে তোমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে যাবে।
হজরত রাসূলে কারীম [সা] ওহির মাধ্যমে মুতার প্রতি মুহূর্তের খবর লাভ করে মদিনায় উপস্থিত লোকদের সামনে বর্ণনা করছিলেন।
মুতার খবর আসার পূর্বেই রাসূল [সা] মদিনায় যায়িদ, জাফর ও আবদুল্লাহর শাহাদাতের খবর দান করেন। তিনি বলেন : যায়িদ ঝাণ্ডা হাতে নেয় এবং সেও শহীদ হয়। তিনি এ কথা বলছিলেন আর তাঁর দুই চোখ থেকে অশ্রগড়িয়ে পড়ছিল।
মুতার তিন সেনাপতির মৃত্যুর খবর রাসূলুল্লাহর [সা] নিকট পৌঁছলে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে এই বলে দুআ করেন: আল্লাহ তুমি যায়িদকে ক্ষমা করে দাও। এ কথা তিনবার বলেন, তারপর বলেন: আল্লাহ তুমি জাফর ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে ক্ষমা করে দাও।
সামরিক দক্ষতা ছাড়াও হজরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার আরও অনেক যোগ্যতা ছিল।
এ কারণে রাসূলুল্লাহ [সা] তাঁকে সমাদর করতেন অনেক বেশি।
সেই জাহিলী আরবে যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক আরবিতে লেখা জানতো, আবদুল্লাহ তাদের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল [সা] তাঁকে স্বীয় কাতিব [লেখক] হিসাবে নিয়োগ করেন।
তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন বিখ্যাত কবি।
কবি হাসসান কুরাইশদের বংশ ও রক্তের ওপর আঘাত হানতেন, কবি কাব কুরাইশদের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অতীত ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের দোষ-ত্রটি তুলে ধরতেন। পক্ষান্তরে আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাদের কুফরীর জন্য নিন্দা ও ধিক্কার দিতেন।
আবদুল্লাহ ছিলেন স্বভাব কবি। উপস্থিত কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।
হজরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম [রা] বলেন : তাৎক্ষণিক কবিতা বলার ক্ষেত্রে আমি আবদুল্লাহ অপেক্ষা অধিকতর সক্ষম আর কাউকে দেখিনি। একদিন তিনি মসজিদে নববীতে গেলেন। পূর্বেই সেখানে হযরত রাসূলে কারীম [সা] একদল সাহাবীর সাথে বসে ছিলেন। তিনি আবদুল্লাহকে কাছে ডেকে বলেন, তুমি এখন মুশরিকদের সম্পর্কে কিছু কবিতা শোনাও। আবদুল্লাহ কিছু কবিতা শোনালেন। কবিতা শুনে রাসূল [সা] একটু হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহ তোমাকে অটল রাখুন।
আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ছিলেন একজন দুনিয়া বিরাগী আবিদ ও সব সময় আল্লাহকে স্মরণকারী ব্যক্তি।
জিহাদের প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ।
বদর থেকে নিয়ে মুতা পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে তার একটিতেও তিনি অনুপস্থিত থাকেননি।
আবদুল্লাহ সবার আগে যুদ্ধে বের হতেন এবং সবার শেষে ঘরে ফিরতেন।
হজরত রাসূলে কারীমের আদেশ-নিষেধ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা যেমন রাসূলকে [সা] গভীরভাবে ভালোবাসতেন তেমনি রাসূলও [সা] তাকে ভীষণ ভালবাসতেন।
রাসূলের [সা] সেই ভালোবাসার নজির রয়ে গেছে প্রচুর।
কবি হলেও হজরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ছিলেন সকল সময় দীনের প্রতি একনিষ্ঠ।
সততা ও সাহস ছিল তাঁর একান্ত ভূষণ।
আর মানবিকতা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল সীমাহীন।
এ ধরনের বহু গুণের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর জীবনে।
এ জন্যই তো তিনি হতে পেরেছিলেন বিরল এক পুরুষ। যার দৃষ্টান্তের সুবাতাস বয়ে যায় নিরন্তর।