true story:সত্য গল্প,
হৃদয় তো নয়, বিশাল সাগর
কায়েস মাহমুদ
(www.kishorkanthabd.com/ মাসিক কিশোরকন্ঠ থেকে সংগৃহীত)
কি ভীষণ
ঝড়োহাওয়া!
ঝড়োহাওয়া
বয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে!
প্রতিটি মুমিনই
একেকজন সাহসী যোদ্ধা!
অসীম মনোবলের
একেকটি পাথরের দুর্গ!
দুর্গ নয়!
তারা সত্যের
মুজাহিদ।
আর মুজাহিদরা
তো এমনই হয়!
ইসলামের
ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ বদর।
আবু তালহা!
বদরের এক
দুঃসাহসী সৈনিক!
তিনি অতি সাহস
ও উৎসাহের সাথে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এই যুদ্ধের
অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বারবার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন।
কেমন ছিল সেই
দিনটি!
বদর সম্পর্কে
তিনি বলছেন : বদরে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আমার হাত থেকে তরবারি পড়ে গিয়েছিল।
একবার নয়, তিন তিনবার!
আর এ সম্পর্কে
আল্লাহ বলেছেন, ‘স্মরণ কর, তিনি তাঁর পক্ষ থেকে স্বস্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায়
আচ্ছন্ন করেন।’
বিস্ময়কর বটে, বদর যুদ্ধের ময়দানে এক সময় ক্ষণিকের জন্য মুসলিম
বাহিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
এতে তাঁদের
ক্লান্তি ও ভয়ভীতি দূর হয়ে যায়।
উহুদ যুদ্ধে
আবু তালহা আল্লাহর নবীর জন্য আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
এ যুদ্ধে তিনি
ছিলেন তীরন্দাজ বাহিনীর সদস্য।
প্রচণ্ড
যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে দূরে ছিটকে
পড়ে। তখন আবু তালহাসহ
মুষ্টিমেয় কিছু সৈনিক নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাসূলুল্লাহকে (সা) ঘিরে শত্র“বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন।
এদিন তিনি
রাসূলুল্লাহকে (সা) নিজের পেছনে আড়াল করে রেখে শত্র“দের দিকে তীর ছুড়ছিলেন।
একটি তীর
ছুড়লে রাসূল (সা) একটু মাথা উঁচু করে দেখছিলেন, তা কোথায় গিয়ে পড়ছে।
আবু তালহা
রাসূলুল্লাহর বুকে হাতে দিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বসুন!
এভাবে থাকুন।
তাহলে আপনার গায়ে কোন তীর লাগবে না।
তিনি একটু মাথা
উঁচু করলেই আবু তালহা খুব দ্রুত তাঁকে আড়াল করে দাঁড়াচ্ছিলেন।
সেদিন তিনি
রাসূলকে (সা) বলেছিলেন, আমার এ বুক
আপনার বুকের সামনেই থাকবে।
এক পর্যায়ে তিনি
রাসূলকে (সা) বলেন, আমি শক্তিশালী সাহসী মানুষ।
আপনার যা
প্রয়োজন আমাকেই বলুন।
তিনি শত্র“দের বুক লক্ষ্য করে তীর ছুড়ছিলেন আর গুন গুন করে কবিতার একটি পঙ্ক্তি
আওড়াচ্ছিলেন : ‘আমার জীবন হোক আপনার জীবনের প্রতি উৎসর্গ, /আমার মুখমণ্ডল হোক আপনার মুখমণ্ডলের ঢাল।’
আবু তালহা
ছিলেন একজন শক্তিশালী সাহসী বীর পুরুষ।
উহুদ যুদ্ধে
তিনি যুদ্ধ করতে করতেই দুই-তিনখানি ধনুক ভেঙেছিলেন।
কী সাংঘাতিক
ব্যাপার!
আক্রমণের
প্রচণ্ডতায় তাঁর হাত দু’খানি অবশ হয়ে পড়ছিল। তবুও তিনি একবারও একটু উহ্
শব্দ উচ্চারণ করেননি। কারণ, তখন তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) হিফাজত ও নিরাপত্তা।
হজরত আবু তালহা
খাইবার যুদ্ধে যোগদান করেন।
এই যুদ্ধের
সময় তাঁর ও রাসূলুল্লাহ (সা) উভয়ের উট খুবই নিকটে পাশাপাশি ছিল এবং রাসূল (সা) গাধার গোশত
হারাম ঘোষণা করার জন্য ঘোষক হিসেবে তাঁকেই মনোনীত করেন।
এটাও একটি
সৌভাগ্য বটে আবু তালহার জন্য।
এই অভিযান থেকে
ফেরার সময় রাসূলে করীম (সা) ও হজরত সাফিয়া ছিলেন এক উটের ওপর।
মদিনার
কাছাকাছি এসে উটটি হোঁচট খায় এবং আরোহীদ্বয় ছিটকে মাটিতে পড়ে যান।
আবু তালহা
দ্রুত নিজের উট থেকে লাফিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে পৌঁছে বলেন,
ইয়া
রাসূলাল্লাহ! আমাকে আল্লাহ আপনার প্রতি উৎসর্গ করুন! আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন?
রাসূল (সা)
বললেন, না। তবে মহিলার খবর নাও।
আবু তালহা
রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে হজরত সাফিয়ার নিকট যান এবং উটের হাওদা ঠিক করে আবার তাঁকে
বসিয়ে দেন।
হুনাইন যুদ্ধেও
তিনি দারুণ সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন।
এই যুদ্ধে তিনি
একাই বিশ-একুশজন কাফিরকে হত্যা করেন।
রাসূল (সা)
ঘোষণা করেছিলেন, কেউ কোন কাফিরকে হত্যা করলে সে হবে
নিহত ব্যক্তির সকল জিনিসের মালিক।
এ দিন আবু
তালহা একুশ ব্যক্তির সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী হন।
হিজরি অষ্টম
সনে সংঘটিত এই যুদ্ধ ছিল রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ।
এই যুদ্ধের
সময় আবু তালহা হাসতে হাসতে রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! উম্মু সুলাইমের হাতে একটি খঞ্জর, আপনি কি তা দেখেছেন?
রাসূল (সা)
বললেন, উম্মু সুলাইম, এই খঞ্জর দিয়ে কী করবে?
উম্মু সুলাইম
বললেন, মুশরিকরা কেউ আমার নিকটে এলে এটা
দিয়ে তাঁর পেট ফেঁড়ে ফেলবো।
একথা শুনে
রাসূল (সা) হাসতে লাগলেন।
বিদায় হজে আবু
তালহা রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে ছিলেন।
হজরত রাসূলে
করীমের (সা) ইনতিকালের কাছাকাছি সময় মদিনায় সাধারণত দুই ব্যক্তি কবর খুঁড়তেন। মুহাজিরদের
মধ্যে আবু উবাইদাহ্ ইবনুল জাররাহ।
তিনি খুঁড়তেন
মক্কাবাসীদের মত।
আর আনসারদের
মধ্যে আবু তালহা।
তিনি খুঁড়তেন
মদিনাবাসীদের মত।
হজরত রাসূলে
করীমের (সা) ওফাতের পর সাহাবায়ে কিরাম মসজিদে নববীতে বসে দাফন-কাফনের বিষয়
পরামর্শ শুরু করলেন।
প্রশ্ন দেখা
দিল, কে এবং কোন পদ্ধতিতে কবর তৈরি করবে?
উপরোক্ত দুই
ব্যক্তি তখন এই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন না।
হজরত আব্বাস
(রা) একই সময়ে দুইজনের নিকট লোক পাঠালেন তাঁদেরকে ডেকে আনার জন্য। সিদ্ধান্ত হলো, এই দুইজনের মধ্যে যিনি আগে পৌঁছুবেন তিনিই এই সৌভাগ্যের অধিকারী
হবেন।
তাঁদের ডাকার
জন্য লোক পাঠিয়ে দিয়ে হজরত আব্বাস (রা)সহ উপস্থিত সাহাবীরা দু’আ করতে লাগলেন :
হে আল্লাহ, আপনার নবীর জন্য এই দুইজনের একজনকে নির্বাচন করুন।
কিছুক্ষণের
মধ্যে যে ব্যক্তি আবু তালহার খোঁজে গিয়েছিল, তাকে সঙ্গে করে ফিরে আসেন।
অতঃপর আবু
তালহা মদিনাবাসীদের নিয়ম অনুযায়ী রাসূলুল্লাহর (সা) কবর তৈরি করেন।
এটাও তার জন্য
একটি সৌভাগ্য বটে।
হজরত রাসূলে
করীমের (সা) ওফাতের পর বহু সাহাবী মদিনা ছেড়ে শামে আবাসন গড়ে তোলেন।
আবু তালহাও
সেখানকার অধিবাসীদের একজন।
তবে যখনই কোন
দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় পিষ্ট হতেন, তখনই মাসাধিককালের দীর্ঘ
পথ পাড়ি দিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র মাজারে হাজির হতেন এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ
করতেন।
হজরত রাসূলে
করীমের (সা) প্রতি যে তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল, খুব ছোট ছোট ব্যাপারেও তা প্রকাশ পেত। তাঁর বাড়িতে কোন জিনিস এলে তার কিছু রাসূলুল্লাহর (সা) বাড়িতেও
পাঠিয়ে দিতেন।
যখন সূরা আলে
ইমরানের এই আয়াত, ‘তোমরা কোন কল্যাণই লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা
এমন সব জিনিস (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ কর যা তোমাদের নিকট সর্বাধিক প্রিয়’Ñ নাযিল হলো তখন আনসারদের যার কাছে যেসব মূল্যবান জিনিস ছিল সবই রাসূলুল্লাহর
(সা) নিকট নিয়ে গেল এবং আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিল।
আবু তালহা
রাসূলের (সা) নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর ‘বীরাহ’ নামক ভূসম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায়
ওয়াক্ফ করে দিলেন।
এখানে তাঁর
একটি কুয়ো ছিল।
কুয়োটির পানি
ছিল সুস্বাদু।
রাসূল (সা) এর
পানি খুব পছন্দ করতেন।
আবু তালহার এই দানে
রাসূল (সা) খুব খুশি হয়েছিলেন।
একদিন আবু
তালহা তাঁর একটি বাগিচার দেয়ালের পাশে নামাজে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এমন সময় একটি
ছোট্ট পাখি-এদিক ওদিক উড়ে বেরোনোর পথ খুঁজতে থাকে।
কিন্তু ঘন
খেজুর গাছের জন্য বেরোনোর পথ পেল না।
আবু তালহা
নামাজে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এই অবস্থা দেখলেন।
এদিকে নামাজ কত
রাকায়াত পড়েছেন তা আর স্মরণ করতে পারলেন না।
ভাবলেন, এই সম্পদই আমাকে ফিতনা এবং বিপর্যয়ে ফেলেছে।
নামাজ শেষ করে
তিনি ছুটে গেলেন রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে।
ঘটনার বর্ণনা
দিয়ে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ সবই আমি দান করে
দিলাম। এই সম্পদ আপনি আল্লাহর পথে কাজে লাগান।
রাসূল (সা)
তাঁকে বললেন, এই সম্পদ তোমার নিকট-আত্মীয়দের মধ্যে
বণ্টন করে দাও।
নির্দেশমত তিনি
যাঁদের মধ্যে বণ্টন করে দেন তাঁদের মধ্যে হাসসান ইবন সাবিত ও উবাই ইবন কাবও ছিলেন।
একবার এক
ব্যক্তি মদিনায় এলো, সেখানে
থাকা-খাওয়ার কোন সংস্থান তার ছিল না।
রাসূল (সা)
ঘোষণা করলেন, যে এই লোকটিকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ
করবে আল্লাহ তার ওপর সদয় হবেন।
আবু তালহা সাথে
সাথে বললেন, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।
বাড়িতে ছোট
ছেলেমেয়েদের খাবার ছাড়া অতিরিক্ত কোন খাবার ছিল না।
আবু তালহা
স্ত্রীকে বললেন, এক কাজ কর, তুমি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াও। তারপর মেহমানের সামনে খাবার হাজির করে কোন এক ছুতোয় আলো নিভিয়ে দাও।
অন্ধকারে আমরা খাওয়ার ভান করে শুধু মুখ নাড়াচাড়া করবো, আর মেহমান একাই পেট ভরে খেয়ে নেবে।
যেই কথা সেই
কাজ।
স্বামী-স্ত্রী
মেহমানকে পরিতৃপ্তিসহকারে আহার করালেন, কিন্তু ছেলেমেয়েসহ নিজেরা উপোস থাকলেন।
সকালে আবু
তালহা এলেন রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে। তিনি ‘তাদের তীব্র প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা অন্যকে নিজেদের ওপর প্রাধান্য দান করেন’Ñএই আয়াতটি তাঁকে পাঠ করে শোনান। তারপর আবু তালহাকে বলেন, অতিথির সাথে তোমাদের রাতের আচরণ আল্লাহর খুব পছন্দ হয়েছে।
নিষ্ঠা ও
আন্তরিকতা ছিল আবু তালহার বিশেষ গুণ।
খ্যাতি ও
প্রদর্শনী থেকে তিনি সব সময় দূরে থাকতেন।
‘বীরাহা’ সম্পত্তি দান করার সময় তিনি কসম খেয়ে রাসূলুল্লাহকে (সা) বললেন, এ কথা যদি গোপন রাখতে সক্ষম হতাম তাহলে কখনো প্রকাশ করতাম না।
এমনই ছিলেন
রাসূলের (সা) একান্ত সাহাবী হজরত আবু তালহা (রা)।
তিনি ছিলেন
সততা ও বিশ্বস্ততার উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ছিলেন ঈমান ও
সাহসে বলীয়ান। উদার ছিল তার বিশাল হৃদয়।
হৃদয় তো নয়, যেন এক বিশাল সাগর।
যে সাগরের
দুর্বার ঢেউ এখনও কম্পন তুলে যায় আকাশে-বাতাসে।
আবু তালহার মত
এমনই এক সফল জীবন কার না প্রত্যাশার বিষয়?
কার জন্য না
লোভনীয়?
বস্তুত, আমরাও হতে চাই তেমনি সাহসী ও সততায় পরিপূর্ণ।
গড়ে তুলতে চাই
প্রকৃত সফল জীবন।
সে কেবল
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
আল্লাহর দীনের
জন্য। রাসূলের (সা) ভালোবাসার জন্য।
আল্লাহপাক তেমন
জীবনই আমাদেরকে গড়ে তোলার সুযোগ দান করুন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন