`শাদ্দাদের বেহেশতের কাহিনী
হযরত হুদ (আঃ) এর আমলে
শাদ্দাদ নামে একজন অতীব পরাক্রমশালী ঐশ্বর্যশালী মহারাজা ছিল। আল্লাহর হুকুমে হযরত
হুদ (আঃ) তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং দাওয়াত গ্রহণ করলে আখেরাতে বেহেশত
লাভ অন্যথায় দোযখে যাওয়া অবধারিত বলে জানান। শাদ্দাদ হযরত হুদ (আঃ) এর কাছে বেহেশত ও দোযখের বিস্তারিত বিবরণ জানতে
চাইলে তিনি জানান। শাদ্দাদ তাকে বলল,তোমার আল্লাহর বেহেশত আমার প্রয়োজন নেই।বেহেশতের
যে নিয়ামত ও সুখ-শান্তির বিবরণ তুমি দিলে ,অমন বেহেশত আমি নিজে এই পৃথিবীতেই
বানিয়ে নিব।তুমি দেখে নিও।
হযরত হুদ (আঃ) তাকে
হুশিয়ার করে দিলেন যে,আল্লাহ পরকালে যে বেহেশত তৈরী করে রেখেছেন,তোমার বানানো
বেহেশত তার ধারে কাছেও যেতে পারবেনা। অধিকন্তু তুমি আল্লাহর সাথে পাল্লা দেয়ার
জন্য অভিশপ্ত হবে। কিন্তু শাদ্দাদ কোন হুশিয়ারীর তোয়াক্কা করলো না। সে সত্যি সত্যিই
দুনিয়ার উপর একটি সর্ব-সুখময় বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা করল। তার ভাগ্নে জোহাক
তাজী তখন পৃথিবীর অপ্র প্রান্তে এক বিশাল সম্রাজ্যের অধিকারী ছিল। অধিকন্তু
পারস্যের সম্রাট জামশেদের সম্রাজ্য দখল করে সে প্রায় অর্ধেক দুনিয়ার প্রতাপন্বিত সম্রাটে
পরিনত হয়েছিল।
মহারাজা শাদ্দাদ সম্রাট
জোহাক তাজী কে চিঠি লিখে তার বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা জানালো। অতঃপর তাকে লিখলো
যে,তোমার রাজ্যে যত স্বর্ণ-রৌপ্য,হিরা-জহরত ও মনি-মাণীক্য আছে,তা সব সংগ্রহ করে
আমার দরবারে পাঠিয়ে দাও। আর মিশক-আম্বর জাতীয় সুগন্ধী দ্রব্য যত আছে,তা পাঠিয়ে
দাও।
অন্যান্য রাজা-মহারাজাদের
কাছেও সে একই ভাবে চিঠি লিখলো এবং বেহেশত নির্মানের পরিকল্পনা জানিয়ে সবাইকে
প্রয়োজনীয় নির্মান সামগ্রী পাঠানোর আদেশ জারী করলো।পৃথিবীর সকল অঞ্চলের অনুগত
রাজা-মহারাজারা তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল।
এবার বেহেশতের স্থান
নির্বাচনের পালা। বেহেশত নির্মানের উপযুক্ত স্থান খুজে বের করার জন্য শাদ্দাদ বহু
সংখ্যক সরকারী কর্মচারী কে নিয়োগ করল। অবশেষে ইয়ামানের একটি শস্য শ্যামল অঞ্চলে
প্রায় একশ চল্লিশ বর্গ মাইল এলাকার একটি জায়গা নির্বাচন করা হল।
বেহেশত নির্মানের জন্য
নির্মান সামগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে বাছাই করা দক্ষ মিস্ত্রী আনা হল।প্রায় তিন
হাজার সুদক্ষ কারিগর কে বেহেশত নির্মানের জন্য নিয়োগ করা হল। নির্মান কাজ শুরু হয়ে
গেলে শাদ্দাদ তার অধীনস্থ প্রজাদের জানিয়ে দিল জে,কারো নিকট কোন সোনা রূপা থাকলে
সে যেন তা গোপন না করে এবং অবিলম্বে তা রাজ দরবারে পাঠিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে তল্লাশী
চালানোর জন্য হাজার হাজার কর্মচারী নিয়োগ করা হল। এই কর্মচারীরা কারো কাছে এক কণা পরিমাণ
সোনা-রূপা পেলেও তা কেড়ে নিতে লাগল। এক বিধবার শিশু মেয়ের কাছে চার আনা পরিমান
রূপার গহণা পেয়ে তাও তার কেড়ে নিল। মেয়েটি
কেদে গড়াগড়ি দিতে লাগল। তা দেখে বিধবা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাল যে, হে আল্লাহ
,এই অত্যাচারী রাজা কে তুমি তার বেহেশত ভোগ করার সুযোগ দিও না। দুঃখিনী মজলুম
বৃদ্ধার এই দোয়া সম্ভবত কবুল হয়ে গিয়ে ছিল।
ওদিকে মহারাজা শাদ্দাদের
বেহেশত নির্মানের কাজ ধুমধামের সাথে চলতে লাগল। বিশাল ভূখন্ডের চারদিকে চল্লিশ গজ
জমি খনন করে মাটি ফেলে মর্মর পাথর দিয়ে বেহেশতের
ভিত্তি নির্মান করা হল। তার উপর সোনা ও রূপার ইট দিয়ে নির্মিত হল প্রাচীর।
প্রাচীরের উপর জমরূদ পাথরের ভীম ও বর্গার উপর লাল বর্ণের মূল্যবান আলমাছ পাথর
ঢালাই করে প্রাসাদের ছাদ তৈরী হল। মূল প্রাসাদের ভিতরে সোনা ও রূপার কারূকার্য
খচিত ইট দিয়ে বহু সংখ্যক ছোট ছোট দালান তৈরী করা হল।
সেই বেহেশতের মাঝে মাঝে তৈরী করা হয়েছিল সোনা ও রূপার গাছ-গাছালি এবং সোনার ঘাট ও তীর বাধা পুস্করিনী
ও নহর সমূহ। আর তার কোনটি দুধ,কোনটি মধু ও কোনটি শরাব দ্বারা ভর্তি করা হয়েছিল।
বেহেশতের মাটির পরিবর্তে শোভা পেয়েছিল সুবাসিত মেশক ও আম্বর এবং মূল্যবান পাথর
দ্বারা তার মেঝে নির্মিত হয়েছিল। বেহেশতের প্রাঙ্গন মনি মুক্তা দ্বারা ঢালাই করা
হয়েছিল।
বর্ণিত আছে যে,এই বেহেশত নির্মাণ করতে প্রতিদিন অন্ততঃ চল্লিশ হাজার গাধার
বোঝা পরিমান সোনা-রূপা নিঃশেষ হয়ে যেত।এইভাবে একাধারে তিনশ’ বছর ধরে নির্মাণ কাজ
সম্পন্ন হয়।
এরপর কারিগরগণ শাদ্দাদ কে জানাল যে,বেহেশত নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। শাদ্দাদ
খুশী হয়ে আদেশ দিল জে,এবার রাজ্যের সকল সুন্দ যুবক-যুবতী ও বালক-বালিকাকে বেহেশতে এনে
জড়ো করা হোক। নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হল।
অবশেষে একদিন শাদ্দাদ
সপরিবারে বেহেশত অভিমুখে রওনা হল।তার অসংখ্য লোক-লস্কর বেহেশতের সামনের প্রান্তরে
তাকে অভবাদন জানাল। শাদ্দাদ অভবাদন গ্রহণ করে বেহেশতের প্রধান দরজার কাছে গিয়ে
উপনীত হল। দেখল,একজন অপরিচিত লোক বেহেশতের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শাদ্দাদ তাকে
জিজ্ঞেস করল,তুমি কে?
লোকটি বললেনঃ আমি মৃত্যুর
ফেরেশতা আজরাঈল।
শাদ্দাদ বললঃ তুমি এখন
এখানে কি উদ্দেশ্য এসেছ?
আজরাঈল বললেনঃ আমার প্রতি
নির্দেশ এসেছে তোমার জান কবজ করার।
শাদ্দাদ বললঃ আমাকে একটু
সময় দাও।আমি আমার তৈরী পরম সাধের বেহেশতে একটু প্রবেশ করি এবং এক নজর ঘুরে দেখি।
আজরাঈল বললেনঃ তোমাকে এক
মুহুর্তও সময় দানের অনুমতি নেই।
শাদ্দাদ বললঃ তাহলে অন্ততঃ আমাকে ঘোড়া থেকে
নামতে দাও।
আজরাঈল বললেনঃ না,তুমি যে
অবস্থায় আছ,সে অবস্থায়ই তোমার জান কবজ করা হবে।
শাদ্দাদ ঘোড়া থেকে এক পা
নামিয়ে দিল।কিন্তু তা বেহেশতের চৌকাঠ স্পর্শ করতে পারলনা। এই অবস্থায় তার মৃত্যু
ঘটল।তার বেহেশতের আশা চিরতরে নির্মূল হয়ে গেল।
ইতঃমধ্যে আল্লাহর
নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আঃ)এক প্রচন্ড আওয়াজের মাধ্যমে শাদ্দাদের বেহেশত ও
লোক-লস্কর সব ধ্বংস করে দিলেন।এভাবে শাদ্দাদের রাজত্ব চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
বর্ণিত আছে যে,হযরত
মুয়াবিয়ার (রাঃ) রাজত্বকালে আব্দুল্লাহ বিন কালব নামক এক ব্যক্তি ইয়ামানের একটি
জায়গায় একটি মূল্যবান পাথর পেয়ে তা হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) নিকট উপস্থাপন করেন।
সেখানে তখন কা’ব বিন
আহবার উপস্থিত ছিলেন।তিনি উক্ত মূল্যবান রত্ন দেখে বললেন,এটি নিশ্চয় শাদ্দাদ
নির্মিত বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ। কেননা আমি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে,আমার
উম্মতের মধ্যে আব্দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি শাদ্দাদ নির্মিত বেহেশতের স্থানে গিয়ে
কিছু নিদর্শন দেখতে পাবে।
শিক্ষাঃ
1. আল্লাহর নাফরমানীর শাস্তি তিনিই দিয়ে থাকেন।
2. জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দখলকৃত সম্পদ কোন কাজে লাগেনা
বরং এটা বিপদের কারন হয়ে থাকে।
3. এতীম ও মজলুমের দোয়া আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়।
4. আমেরিকায় স্যান্ডির তান্ডবও আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি
হতে পারে কারন তারা সিনেমার মাধমে তার রাসূল
(সাঃ) কে অপমান করেছে।
(হাদীসের কিসসা-আকরাম ফারুক থেকে সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন