যদি তুমি পবিত্র কোরআনে বিশ্বাসী হও
একবার জাহাম ইবনে সফওয়ান- ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)
–এর খেদমতে হাজির হয়ে বলল, কতিপয় মাসআলা নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে আমি এসেছি ।
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- তোমার সাথে কথা বলা লজ্জার ব্যাপার এবং তোমরা যে বিষয়ে প্রবেশ করেছো , তাতে অংশ গ্রহণ আগুনে প্রবেশ সদৃশ ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- আমার সাথে কোন আলাপ-আলোচনা ছাড়াই আপনি এই অভিমত ব্যক্ত করলেন?
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- তোমাদের যে সব অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গি আমার পর্যন্ত বিশ্বস্ত সুত্রে পৌঁছেছে, তা কোন মুসলমানের অভিমত হতে পারে না ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- আপনি না জেনে-বুঝে আমার ব্যাপারে ফয়সালা দিচ্ছেন ?
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- তোমাদের এ সব অভিমত সুপ্রসিদ্ধ । সাধারণ– অসাধারণ সকল মানুষই তা জানে । সুতরাং আমি সম্পুর্ণ আস্থার সাথেই তোমার ব্যাপারে যা বলার বলেছি ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- আমি আপনাকে শুধু ঈমানের স্বরূপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছি ।
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- তুমি এখনো ঈমানের স্বরূপ জানতে পারনি যে প্রশ্নের প্রয়োজন পড়ল?
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ-
ঈমানের একটি দিকের ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে , তা দূরিভূত করতে চাই ।
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- ঈমানের মাঝে সন্দেহ করা হচ্ছে কুফুরী ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- কুফুরীর কারণ আমাকে জানানো আপনার জন্য সমীচিন হবে না ।
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- বল, কি বলতে চাচ্ছ?
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- এক ব্যক্তি তার অন্তর দ্বারা আল্লাহ্কে চিনল এবং জানল যে , তিঁনি এক-অদ্বিতীয় ,তাঁর সমতূল্য ও সমকক্ষ কেউ নেই , তাঁর গুণাবলী সম্পর্কেও
সে অবগত; কিন্তু সে এসব বিষয় স্বীকার ব্যতীতই মরে গেল । এ ব্যক্তির মৃত্যু কি কুফুরীর ওপর হল, না ইসলামের ওপর ?
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)-এ ব্যক্তি কাফের ,জাহান্নামী । অন্তরের বিশ্বাসের সাথে মুখের স্বীকৃতির সমন্বয় না থাকলে তা কুফুরী ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ- কেমন করে সে মুমিন নয়, যখন সে আল্লাহ্কে তাঁর গুনাবলী সহ বিশ্বস করল ?
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- যদি তুমি পবিত্র কোরআনে বিশ্বাসী হও এবং ইসলামী শারী’আতকে হুজ্জত বলে গ্রহ্ণ কর , তবে আমি কোরআন এর দলিল পেশ করবো ।আর যদি এমনটি না হয় ,তবে আমি তোমার সাথে সে পরিমাপেই কথা বলবো , যেভাবে ইসলাম বিরোধীদের সাথে হয়ে থাকে ।
জাহাম ইবনে সফওয়ানঃ-আমি কোরআনের ওপর বিশ্বাসী এবং একে হুজ্জত বলে বিশ্বাস করি ।
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)-আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ঈমান কে দু’টি অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত করেছেন । একটি হল ,হৃদয়-মন, দ্বিতীয়টি ভাষা বা উচ্চারণ ।
যেমন ইরশাদ হচ্ছে……
“তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যখন শোনে তখন তাদের চোখ অশ্রুসজল দেখতে পাবেন । এ কারণে যে ,তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে ।তারা বলে , হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা বিশ্বাস করেছি, সূতরাং তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের অন্তর্ভূক্ত কর । আমাদের কি উযর থাকতে পারে যে , আল্লাহ্র প্রতি এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো না এবং এ আশা করব না যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎ লোকদের অন্তর্ভূক্ত করবেন ? তাদের এ কথার জন্য আল্লাহ্ তাদের পু্রস্কার নির্দিষ্ট করেছেন জান্নাত্ ,যার তলদেশে নদী প্রবাহিত । তারা সেখানে স্থায়ী হবে । এই হল সৎ্কর্মপরায়ণদের পু্রস্কার” ।
………(সূরা – মায়েদা-৮৩-৮৫)
ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- বলেন , এই আয়াতে মহান আল্লাহকে উপলদ্ধি বা জানা এবং স্বীকৃতিকে জান্নাতী হওয়ার কারণ বলেছেন এবং হৃদয় ও মুখের উচ্চারণ বা স্বীকৃতিকে মোমিন হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন ।
আল্লাহ্ তা’আলা আরও ইরশাদ করেছেন-……
“তোমরা বল , আমরা আল্লাহতে ঈমান রাখি , যা আমাদের প্রতি এবং ইব্রাহীম (আঃ),ইসমাঈল(আঃ), ইসহাক (আঃ),ইয়াকূব(আঃ), ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে”।
আরও ইরশাদ হয়েছে-… “যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী , তাদেরকে ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ্ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন”। ……(সূরা –ইবরাহীম-২৭)
এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী শোন……
“তোমরা ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’-বল সফল্-কাম হবে” ।
এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, কামিয়াবী ও সফলতা উপলব্ধি ও জানার মধ্যে নয় ,বরং এতে বলা বা স্বীকৃতিও সম্পৃক্ত রয়েছে ।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন…
“যে ব্যক্তি মুখে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলল এবং সে ব্যক্তি হৃদয়েও তার প্রতি ঈমান রাখে ,তবে সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে” ।
এখানে তিঁনি বলেন নি যে, যে ব্যক্তি অন্তরে আল্লাহ্র পরিচয় উপলব্ধি করল তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে বরং বলেছেন , যে ব্যক্তি মুখে এই কালিমা- “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলবে , সে মুক্তি পাবে ।
যদি
হৃদয়ের উপলব্ধি যথেষ্ট হত এবং মুখের স্বীকৃতির কোন প্রয়োজন না হত , তবে যে ব্যক্তি মুখে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে , সে ও আল্লাহর পরচিতি উপলব্ধি করে বা জেনে মুমিন হয়ে যেত ।
এমতাবস্থায় ইবলিস শয়তানেরও মুমিন হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না ।
কেননা আল্লাহ্ পরিচিতি ও উপলব্ধি তার মধ্যে ছিল । সে সম্যক অবগত ছিল যে , আল্লাহ্ তা’আলা তার সৃষ্টিকর্তা, মৃত্যুদাতা , জীবনদাতা এবং তাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতকারী ।
যেমন ইবলিস বলেছিল—
“প্রভূ হে! আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন” ।(সূরা-হিজর-৩৯)
তারপর বলেছিল…“তাই কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন” । (সূরা-হিজর-৩৬)
আরো বলেছিল…
“আপনি আমাকে অগ্নি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মাটি হতে” । (সূরা-ছ্বদ্ব-৭৬)
যদি শুধু আল্লাহ্র পরচিতি জানা ও উপলব্ধি ঈমান হত , তবে কাফির সম্প্রদায়ের আল্লাহর পরচিতি জানার পরও মুখে অস্বীকৃতি সত্ত্বেও তারা মুমিন হত ।
অথচ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন …
“বিশ্বাস করা সত্ত্বেও তারা অস্বীকার করেছিল” ।(সূরা-নম্ল-১৪)
এই আয়াতে আল্লাহ্র একত্ববাদের বিশ্বাস রাখা সত্ত্বেও তাদেরকে মুমিন বলা হল না , কেননা তারা মুখে অস্বীকার করেছিল ।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন …
“তারা আল্লাহ্র নিয়ামত-রাজী সম্পর্কে জেনেও অস্বীকার করে,
তাদের অধিকাংশই কাফির”। (সূরা-নাহল-৮৩)
উপরোক্ত আয়াতসমুহের মর্মবাণীর ওপর চিন্তা করলে স্পস্ট বুঝা যায় যে, মুখের স্বীকৃতি ছাড়া শুধু উপলব্ধি কোন কাজের নয় । কাফের-গণের জানার ব্যাপারে কোন ত্রুটি ছিল না ।
যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন……
“তারা আপনাকে এমনভাবে চিনে যেমন তারা তাদের সন্তানদের চিনে” । (সূরা-বাকারা-১৪৬)
যখন ইমামে আ’যম আবূ হানিফা (রঃ)- এসব দলীল –প্রমাণ উপস্থাপন করলেন তখন জাহাম ইবনে সফওয়ান বললেন, আপনি আমার হৃদয় রাজ্যকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন । পুণরায় আমি আপনার সান্নিধ্যে হাজির হবো ।………আল-মানাকিব –মাক্কী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন