মানুষের নফসের/অন্তরের রূপ
কুরআনুল কারীমে
মানুষের নফসের তিনটি রূপ উল্লেখ করা হয়েছে–
১) নফসে আম্মারাঃ একটি ‘নফস’ মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। এটির নাম ‘নফসে
আম্মারা’ ।
২) নফসে ‘লাউয়ামাহঃ একটি ‘নফস’ ভুল বা অন্যায় কাজ করলে অথবা ভুল বা
অন্যায় বিষয়ে চিন্তা করলে কিংবা খারাপ নিয়ত রাখলে লজ্জিত হয় এবং সেজন্য মানুষকে
তিরস্কার ও ভৎর্সনা করে। এটির নাম নফসে ‘লাউয়ামাহ’। আধুনিক পরিভাষায় একেই আমরা বিবেক বলে থাকি। [সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ২]
৩) নফসে
মুতমাইন্নাহঃ যে নফসটি সঠিক পথে চললে এবং ভুল ও অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করলে
তৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে তাকে বলে ‘নফসে মুতমাইন্নাহ’। [সূরা
আল ফাজর, আয়াত ২৭]
নাফসুল লাউওয়ামার ব্যাপারে তাফসীরে এসেছেঃ
পৃথিবীতে এমন
কোন মানুষ নেই যার মধ্যে বিবেক বলে কোন জিনিস নেই। এ বিবেকের মধ্যে অনিবার্যরূপে
ভাল এবং মন্দের একটি অনুভূতি বিদ্যমান। মানুষ ভাল এবং মন্দ যাচাইয়ের যে মানদণ্ডই
স্থির করে থাকুক না কেন এবং তা ভুল হোক বা নির্ভুল হোক, চরম অধঃপতিত ও বিভ্রান্ত মানুষের বিবেকও মন্দ কাজ করলে কিংবা ভাল কাজ
না করলে তাকে তিরষ্কার করে। এটিই প্রমাণ করে যে, মানুষ
নিছক একটি জীব নয়, বরং একটি নৈতিক সত্ত্বাও বটে।
প্রকৃতিগতভাবেই তার মধ্যে ভাল এবং মন্দের উপলব্ধি বিদ্যমান। সে নিজেই ভাল এবং মন্দ
কাজের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে। সে অন্যের সাথে যখন কোন খারাপ আচরণ করে তখন সে
ব্যাপারে নিজের বিবেকের দংশনকে দমন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও অন্য কেউ যখন তার
সাথে একই আচরণ করে তখন আপনা থেকেই তার বিবেক দাবী করে যে, এ ধরনের আচরণকারীর শাস্তি হওয়া উচিত। এখন কথা হলো, মানুষের নিজ সত্তার মধ্যেই যদি এ ধরনের একটি “নফসে লাউয়ামাহ” বা
তিরষ্কারকারী বিবেকের উপস্থিতি একটি অনস্বীকার্য সত্য হয়ে থাকে, তাহলে
এ সত্যটিও অনস্বীকার্য যে, এ “নফসে
লাউয়ামা”ই মৃত্যুর পরের জীবনের এমন একটি প্রমাণ যা
মানুষের আপন সত্তার মধ্যে বিদ্যমান।
কেননা যেসব ভাল এবং মন্দ কাজের জন্য মানুষ
দায়ী সেসব কাজের পুরস্কার বা শান্তি তার অবশ্যই পাওয়া উচিত। এটাই প্রকৃতির
স্বাভাবিক দাবী। কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবন ছাড়া আর কোনভাবেই তার এ দাবী পূরণ হতে
পারে না।মৃত্যুর পরে মানুষের সত্তা যদি বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে তার অনেক
ভাল কাজের পুরস্কার থেকে সে নিশ্চিতরূপে বঞ্চিত থেকে যাবে। আবার এমন অনেক মন্দ কাজ
আছে যার ন্যায্য শাস্তি থেকে সে অবশ্যই নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন
কোন মানুষই এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না।
নাফসুল মুতমাইন্নাহর তাফসীর আলোচনাঃ
‘প্রশান্ত আত্মা’ বলে এমন মানুষকে বুঝানো হয়েছে
যে, কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই পূর্ণ নিশ্চিন্ততা
সহকারে ঠাণ্ডা মাথায় এক ও লা-শরীক আল্লাহকে নিজের রব এবং নবীগণ যে সত্য দ্বীন
এনেছিলেন তাকে নিজের দ্বীন ও জীবন বিধান হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের
কাছ থেকে যে বিশ্বাস ও বিধানই পাওয়া গেছে তাকে সে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নিয়েছে।
আল্লাহর দ্বীন যে জিনিসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তাকে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নয় বরং এই
বিশ্বাস সহকারে বর্জন করেছে যে, সত্যিই তা খারাপ।
সত্য-প্রীতির পথে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সে নির্দ্ধিধায় তা
করেছে। এই পথে যেসব সংকট, সমস্যা, কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে হাসি মুখে সেগুলো বরদাশত
করেছে।
অন্যায় পথে চলে লোকদের দুনিয়ায় নানান ধরনের স্বার্থ, ঐশ্বর্য ও সুখ-সম্ভার লাভ করার যেসব দৃশ্য সে দেখছে তা থেকে বঞ্চিত
থাকার জন্য তার নিজের মধ্যে কোন ক্ষোভ বা আক্ষেপ জাগেনি। বরং সত্য দ্বীন অনুসরণ
করার ফলে সে যে এই সমস্ত আবর্জনা থেকে মুক্ত থেকেছে, এজন্য
সে নিজের মধ্যে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা অনুভব করেছে। কুরআনের অন্যত্র এই অবস্থাটিকে ‘শারহে সদর’ বা হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়া অর্থে
বর্ণনা করা হয়েছে। (আল আন’আম, ১২৫)
[তাফহীম]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন