সোমবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

মাদইয়ানবাসীদের কাহিনী (কোরআনে বর্ণিত)


মাদইয়ানবাসীদের কাহিনী (কোরআনে বর্ণিত)

৮৫) আর মাদইয়ানবাসীদের কাছে আমি তাদের ভাই শোআইবকে পাঠাই৷ সে বলেঃহে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই৷ তোমাদের কাছে তোমাদের রবের সুষ্পষ্ট পথনির্দশনা এসে গেছে৷ কাজেই ওজন পরিমাপ পুরোপুরি দাও, লোকদের পাওনা জিনিস কম করে দিয়ো না৷  এবং পৃথিবী পরিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার মধ্যে আর বিপর্যয় সৃষ্টি করো না৷  এরই মধ্যে রয়েছে তোমাদের কল্যাণ ,যদি তোমরা যথার্থ মুমিন হয়ে থাকো৷( সুরা আরাফ,৮৫)

মাদ্ইয়ানের (মাদায়েন) মূল এলাকটি হিজাযের উত্তর পশ্চিমে এবং ফিলিস্তিনের দক্ষিণে লোহিত সাগর আকাবা উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ছিল। তবে সাইনা (সিনাহ) উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলেরও এর কিছুটা অংশ বিস্তৃত ছিল। এখানকার অধিবাসীরা ছিল একটি বিরাট ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। প্রাচীন যুগে যে বাণিজ্যিক সড়কটি লোহিত সাগরের উপকূল ধরে ইয়ামান থেকে মক্কা ইয়াম্বু হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং দ্বিতীয় যে বাণিজ্যিক সড়কটি ইরাক থেকে মিসরের দিকে চলে যেতো তাদের ঠিক সন্ধিস্থলে জাতির জনপদগুলো অবস্থিত ছিল কারণে আরবের ছোট বড় সবাই মাদ্ইয়ানী জাতি সম্পর্কে জানতো এবং জাতিটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও সারা আরবে এর খ্যাতি অপরিবর্তিত থাকে।কারণ আরববাসীদের বাণিজ্যিক কাফেলা মিসর ইরাক যাবার পথে দিন রাত এর ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়েই চলাচল করতো।

মাদ্ইয়ানবাসীদের সম্পর্কে আর একটি প্রয়োজনীয় কথা ভালভাবে জেনে নিতে হবে। সেটি হচ্ছে, মাদ্ইয়ানের অধিবাসীরা হযরত ইবরাহীমের পুত্র মিদিয়ান এর সাথে বিভিন্ন রকমের সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।মিদিয়ান ছিলেন হযরত ইবরাহীমের তৃতীয় স্ত্রীর কাতুরা এর গর্ভজাত সন্তান। প্রাচীন যুগের নিয়ম অনুযায়ী যারা কোন খ্যাতিমান পুরুষের সাথে সম্পর্কিত থাকতো তাদেরকে কালক্রমে ব্যক্তির সন্তান গণ্য করে অমুকের বংশধর বলা হতো। নিয়ম অনুযায়ী আরবের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ বনী ইসমাঈল হিসেবে পরিচিত লাভ করে। অন্যদিকে ইয়াকূবের (অন্য নাম ইসরাঈল) সন্তানদের হাতে ইসলাম গ্রহণকারীদের সবাই বনী ইসরাঈল নামে অভিহিত হয়। অনুরূপ ভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র মিদিয়ানের প্রভাবিত মাদ্ইয়ানের অধিবাসীগণ বনী মিদিয়ান নামে পরিচিত হয় এবং তাদের দেশের নামই হয়ে যায় মাদ্ইয়ান বা মিদিয়ান। ঐতিহাসিক তথ্যটি জানার পর ক্ষেত্রে ধারণা করার আর কোন কারণই থাকে না যে, জাতিটি সর্বপ্রথম হযরত শোআইব আলাইহিস সালামের মধ্যমেই সত্য দীন তথা ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিল। আবির্ভাবকালে এদের অবস্থা ছিল একটি বিকৃত মুসলিম মিল্লাতের মত, যেমন মূসা আলাইহিস সালামের আবির্ভাবকালে ছিল বনী ইসরাঈলের অবস্থা। হযরত ইবরাহীমের পরে ছয় সাত শো বছর পর্যন্ত এরা মুশরিক চরিত্রহীন জাতিদের মধ্যে বাসবাস করতে করতে শিরক নানা রকমের দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সত্ত্বেও এদের ঈমানের দাবী সে জন্যে অহংকার করার মনোবৃত্তি অপরিবর্তিত ছিল

জাতির দুটি বড় দোষ ছিল একটি শিরক এবং অন্যটি ব্যবসায়িক লেন দেনে অসাধুতা দুটি দোষ সংশোধন করার জন্যে হযরত শোআইব আলাইহিস সালামকে তাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল
তারা নিজেরা ঈমানের দাবীদার ছিল তারা আসলে ছিল গোমরাহ বিকৃত মুসলমান বিশ্বাসগত চারিত্রিক বিপর্যয় লিপ্ত থাকলেও তারা কেবল ঈমানের দাবীই করতো না বরং জন্যে তাদের গর্বও ছিল তাই হযরত শোআইব বলেন, যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে তোমাদের বিশ্বাস থাকা উচিত যে,সততা বিশ্বস্ততার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত এবং যেসব দুনিয়া পূজারী লোক আল্লাহ আখেরাতকে স্বীকার করে না তোমাদের ভাল -মন্দের মানদণ্ড তাদের থেকে আলাদা হওয়া উচিত

সুরা আরাফের কিছু আয়াতঃ

৮৬) আর লোকদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করার,ঈমানদারদেরকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা দেবার এবং সোজা পথকে বাঁকা করার জন্য (জীবনের )প্রতিটি পথে লুটেরা হয়ে বসে থাকো না৷ স্মরণ করো, সেই সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে স্বল্প সংখ্যক ৷তারপর আল্লাহ তোমাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন৷ আর বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা কোন ধরনের পরিণামের সম্মুখীন হয়েছে তা একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো৷  

৮৭) যে শিক্ষা সহকারে আমাকে পাঠানো হয়েছে , তোমাদের মধ্য থেকে কোন একটি দল যদি তার প্রতি ঈমান আনে এবং অন্য একটি দল যদি তার প্রতি ঈমান না আনে তাহলে ধৈর্যসহকারে দেখতে থাকো, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেন৷ আর তিনিই সবচেয়ে ভাল ফায়সালাকারী৷  

৮৮) নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মত্ত গোত্রপতিরা তাকে বললোঃহে শোআইব! আমরা তোমাকে তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো৷ অন্যথায় তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের ধর্মে৷শোআইব জবাব দিলোঃআমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে? তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে  

৮৯) আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো৷ আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া আর কোনক্রমেই সম্ভব নয়৷ আমাদের রবের জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে৷ আমরা তাঁরই ওপর নির্ভর করি৷ হে আমাদের রব! আমাদের আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সবচেয়ে ভাল ফায়সালাকারী৷”  

৯০) তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা, যারা তার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল, পরস্পরকে বললোঃযদি তোমরা শোআইবের আনুগত্য মেনে নাও, তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে৷

৯১) সহসা একটি প্রলয়ংকারী বিপদ তাদেরকে পাকড়াও করে এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্য মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ৯২) যারা শোআইবকে মিথ্যা বলেছিল তারা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যেন সেই সব গৃহে কোনদিন তার বসবাসই করতো না৷ শোআইবকে যারা মিথ্যা বলেছিল অবশেষে তারা ধ্বংস হয়ে যায়৷

মাদইয়ানের ধ্বংসলীলা দীর্ঘকাল পর্যন্ত আশেপাশে বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল তাই দেখা যায়, দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ যবুরের এক স্থানে বলা হয়েছেঃ হে খোদা!অমুক অমুক জাতি তোমার বিরুদ্ধে অংগীকারাবদ্ধ হয়েছে, কাজেই তুমি তাদের সাথে ঠিক তেমনি ব্যবহার করো, যেমন মিদিয়ানের সাথে করেছিল (৮৩:-) ইয়াসঈয়াহ নবী এক স্থানে বনী ইসরাঈলকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, আশূরীয়দেরকে ভয় করো না যদিও তারা তোমাদের জন্যে মিসরীয়দের মতই জালেম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেশী দেরী হবে না, বাহিনীগণের প্রভু তাদের ওপর নিজের দণ্ড বর্ষণ করবেন, এবং তাদের সেই একই পরিণতি হবে যেমব মিদিয়ানের হয়েছিল(যিশাইয়১০: ২২-২৬)

সুরা হুদের কিছু আয়াতঃ

৯৩) হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা নিজেদের পথে কাজ করে যাও এবং আমি আমার পথে কাজ করে যেতে থাকবো৷ শিগগীরই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর লাঞ্ছনার আযাব আসছে এবং কে মিথ্যুক ? তোমরা প্রতীক্ষা করতে থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষারত রইলাম৷” 

৯৪) শেষ পর্যন্ত যখন আমার ফায়সালার সময় এসে গেলো তখন আমি নিজের রহমতের সাহায্যে শোআয়েব তার সাথী মুমিনদের উদ্ধার করলাম৷ আর যারা জুলুম করেছিল একটি প্রচণ্ড আওয়াজ তাদেরকে এমনভাবে পাকড়াও করলো যে, নিজেদের আবাসভূমিতেই তারা নির্জীব নিস্পন্দের মতো পড়ে লইলো

সুরা আনকাবুতের কিছু আয়াতঃ

৩৬) আর মাদইয়ানের দিকে আমি পাঠালাম তাদের ভাই শুআইবকে সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আল্লাহর বন্দেগী করো, শেষ দিনের প্রত্যাশী হও  এবং যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে বাড়াবাড়ি করে বেড়িও না৷”  


৩৭) কিন্তু তারা তার প্রতি মিথ্যা আরোপ করলো৷ শেষে একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্প তাদেরকে পাকড়াও করলো এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে  মরে পড়ে থাকলো৷  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন