মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

সবুজ পাখি হয়ে বেহেশতে উড়ে বেড়ায় শহীদের আত্মা


সবুজ পাখি হয়ে বেহেশতে উড়ে বেড়ায় শহীদের আত্মা





কেএস সিদ্দিকী :

 যারা আল্লাহর পথে শহীদ, আল্লাহর কাছে তারা যেমন মহান মর্যাদার অধিকারী তেমনি দুনিয়াতেও শহীদ নামে তাদের স্মরণ করা হয়। ইসলামে অতি মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানিত শব্দটির ইতিহাস-ঐতিহ্য কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কেননা, তারা যে আদর্শ-শিক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করে থাকেন তাতে তওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠাই থাকে প্রধান লক্ষ্য, যা শিরক বা অংশীবাদকে খ-ন করে এবং হক ও নাহক অর্থাৎ সত্য ও অসত্যের মধ্যে রেখাপাত করে। ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে কোনো ব্যক্তি বা দল আত্ম স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয়Ñ যারা প্রাণ উৎসর্গ করেন তারাই শহীদ। যে কাফের শত্রুদের হাতে নিহত হয় সেও শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করতে পারে, তাকেও শহীদ বলা হয়। কিন্তু কোনো মুসলমানের হাতে কাফের অন্যায়ভাবে মারা গেলে তাকে কখনো শহীদ বলা যাবে না। অন্যায়ভাবে হত্যাকারী মুসলমানও শাস্তিযোগ্য হবে। শাহাদাতের সুমহান মর্যাদা কেবল মুসলমানের জন্য নির্ধারিত বলেই শহীদ উপাধি তারই প্রাপ্য। এ ব্যাখ্যার প্রয়োজন এ কারণে দেখা দিয়েছে যে, কোনো অমুসলিমকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা যাবে কিনা? মুসলমান হতে অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণে যার অস্বীকৃতি থাকে তাকে মুসলমানী শব্দ ‘শহীদ’ আখ্যায়িত করা হলে প্রকৃতই কি সে শহীদ হয়ে যাবে? ইসলামী শরীয়তে শহীদদের যে হুকুম নির্ধারিত এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত তাও জানা থাকা দরকার।
 ful
হাদীস ও ফেকার কিতাবসমূহে শহীদের অসীম মর্যাদার কারণে বিশেষ বিশেষ কিছু আলাদা হুকুম বা নির্দেশের কথা বলা হয়েছে, যা সব মৃত মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নি¤েœ আমরা কোরআন, হাদীস ও ইতিহাসের আলোকে শহীদের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করতে চাই, যাতে শহীদ সম্পর্কে সঠিক ও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন : “এবং যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে যা দান করেছেন উহাতে তারা পরিতুষ্ট এবং তাদের পক্ষ হতে যারা পশ্চাতে থাকে তাদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়নি, তাদের ভয় নেই ও তারা দুঃখিত হবে না।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৯-৭০)
আয়াতে বর্ণিত নিহতরা মৃত নয় জীবিত এবং এরাই শহীদ নামে পরিচিত। জীবিতদের খাদ্যের প্রয়োজন, যা দান করা হয় আল্লাহর পক্ষ হতে। আয়াতে খাদ্যের বর্ণনা নেই যে, তারা কোন প্রকারের বা কোন কোন খাদ্য প্রাপ্ত হবে। তবে হাদীসে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের জবাবে রসূলুল্লাহ (স.) তা ব্যাখ্যা করেছেন।

সাহাবী হযরত মাসরূক (রা.) বর্ণনা করেছেনÑ আমরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে উল্লেখিত আয়াতটির অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। জবাবে তিনি বললেন যে, এ আয়াতের অর্থ আমরা নবী করীম (স.)-কে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে তিনি বলেছিলেন : শহীদগণের আত্মাসমূহ সবুজ পাখির পেটে অবস্থান করে। তাদের জন্য আল্লাহর আর্শে ঝুলন্ত রয়েছে প্রদীপসমূহ। এসব আত্মা বেহেশতে যেখানে ইচ্ছা সেখানে পরিভ্রমণ করতে থাকে এবং ঐসব প্রদীপে প্রত্যাবর্তন করে বিশ্রাম গ্রহণ করে। তাদের প্রতি লক্ষ্য করে তাদের প্রভু পরওয়ারদেগার বলেন : তোমাদের কি জিনিসের জন্য আগ্রহ হয়? তারা আরজ করে আমরা কিসের আগ্রহ করব, অথচ আমরা যেখানে ইচ্ছা বেহেশতের সেখানেই বেড়াতে পারি। আল্লাহ তাদের তিনবার এ ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করেন যে, তারা কি চায়, তারা আগ্রহ ব্যক্ত করতে থাকে যে, তাদের আত্মা পুনরায় তাদের দেহে প্রত্যাবর্তিত করে দেয়া হোক। আল্লাহতা’লা যখন তাদের এ মনোভাবে বুঝতে পারেন, তখন পূর্বাবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দেন। Ñমুসলিম

সবুজ পাখিদের পেটে আত্মাসমূহের অবস্থান করার অর্থ হলো শহীদদের সূক্ষ্ম দেহদান করা হয়। তখন তারা পুনঃজন্মের আশা করে যেন শাহাদতের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারে এবং দ্বীন ধর্মের প্রচার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে। তাদের এ আকাক্সক্ষা দেখে আল্লাহতাআলা অধিক প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স.) তাঁর সাহাবাগণকে বলেন : তোমাদের যেসব ভ্রাতা ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, তাদের আত্মা আল্লাহতাআলা সবুজ পাখিদের পেটে রেখেছেন। এসব আত্মা বেহেশতের নহরগুলোতে (নদ-নদী) গমন করে এবং বেহেশতের ফল খায়। তারা বিশ্রাম গ্রহণ করে আর্শের ঝুলন্ত প্রদীপসমূহে, যখন এসব আত্মা পানাহার ও থাকার এসব গুণাগুণ অবগত হয়, তখন তারা বলে, দুনিয়ায় আমাদের যেসব ভ্রাতা রয়েছেন, তাদের নিকট এই সুসংবাদ কে পৌঁছাবে যে, বেহেশতে আমরা জীবিত আছি, যেন তারাও দুনিয়ার প্রতি অধিক উৎসাহিত না হন এবং জেহাদের প্রতি অবহেলা না করেন। তখন আল্লাহতাআলা তাদেরকে বলেন, আমি তোমাদের পক্ষ হতে দুনিয়াবাসীদের এ সংবাদ জানিয়ে দিচ্ছি। এ ঘটনা উপলক্ষে উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে জীবিকাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। (আবু দাউদ)

একটি অদ্ভুত ঘটনা

শায়খ আরেফবিল্লাহ আমর ইবনে ফারেয মিসরে একটি মাদ্রাসা উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে গমন করেন। সেখানে একটি মসজিদে দেখতে পান, একজন বৃদ্ধ ব্যবসায়ী মসজিদের হাউজে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওজু করছেন। তিনি তাকে বললেন, হে শায়খ! আপনি বৃদ্ধ হয়েও কেন অনিয়মে ওযু করছেন, অথচ আপনি এমন এক শহরের নাগরিক যেখানে ধর্মীয় আলেম-ওলামার অভাব নেই। তাদের কাছ থেকে আপনি ওযুর সঠিক নিয়ম শিখতে পারেননি? একথা শুনে শায়খ বললেন, হে আমর! মিসরে তুমি বিজয় লাভ করতে পারবে না (শায়খ যেহেতু তার নাম উচ্চারণ করে তাকে সম্বোধন করেছেন এবং বিজয় শব্দ ব্যবহার করেন তাই আমর বুঝতে পারেন ইনি কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন তাই)। তিনি একথা শুনে শায়খের নিকটবর্তী হয়ে বলেন, হযরত: বলুন, আমি কোথায় বিজয় লাভ করতে পারব? শায়খ বললেন, মক্কা মোকাররমায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, মক্কা মোকাররমা কোথায়? শায়খ হাতের ইশারায় বললেন, এখানে। শায়খের হাতের ইশারায় মক্কা মোকাররমা আমরের সম্মুখে প্রকাশ পেয়ে যায় এবং তিনি তাতে প্রবেশ করেন। এখানে তিনি কয়েক বছর অবস্থান করেন। এ অবস্থানকালে তার বহু রূহানী (আধ্যাত্মিক) বিজয়সূচিত হয় এবং বিখ্যাত দীওয়ান (কবিতা সংকলন) এখানেই রচনা করেন।

এক যুগ অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি শায়খ মিসরীর আওয়াজ শুনতে পান তিনি বলছিলেন, হে আমর! এখানে এসে আমার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা কর। শায়খ মিসরীর এ বাক্য শুনে আমর মিসরে চলে যান। শায়খ তাকে একটি দীনার প্রদান করে বলেন, এটা দ্বারা আমার কাফন ইত্যাদি ক্রয় করবে এবং আমাকে কাফন পরিয়ে এই স্থানে (হাতে কারাফা নামক কবরস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে) রেখে দেবে। অতঃপর অপেক্ষা করবে কি হয়।

শায়খ আমর ইবনে ফারেয বলেন, এ কথাবার্তার কিছুক্ষণ পর মিসরীয় শায়খের ইন্তেকাল হয়ে যায় এবং আমি তার গোসল দিয়ে এবং কাফন পরিয়ে কারাফা কবরস্থানে তার কফিন রেখে দেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আসমান হতে এক ব্যক্তি অবতরণ করে এবং আমরা দু’জনে তার নামাজে জানাযা আদায় করি। এরপর আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখতে পাই সমস্ত আকাশ সবুজ পাখিতে ভরে গেছে এবং পাখিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাখিটি নিচে নেমে পড়ে এবং শায়খের লাশটি গিলে ফেলে। অতঃপর অন্যান্য পাখিদের সাথে মিলে উড়াল দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

শায়খ ফারেয বলেন, এ দৃশ্য দেখে আমি বিস্মিত হলাম এবং আমার সঙ্গী যাকে নিয়ে আমি শায়খের জানাযা পড়েছিলাম, তিনি বললেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহতাআলা শহীদদের আত্মা সবুজ পাখিদের উদরে রেখে দেন এবং বেহেশতের বাগানে ছেড়ে দেন ও তারা বেহেশতের ফল-ফলাদি আহার করে এবং সেখানে বিচারণ করে ও রাতে আরশের প্রদীপসমূহে অবস্থান করে। (হায়াতুল হায়ওয়ান)

ইবনুল ফারেযের নাম উমর (ভিন্ন মতে আমর) ইবনে আলী। তার যুগ ১১৮১ থেকে ১২৩৫ খ্রি. পর্যন্ত। কায়রোতে তার জন্ম ও মৃত্যু। তিনি বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সূফী সাধক ছিলেন। তিনি মিসরের কাতাম ও হেজাযে অবস্থান করে ছিলেন। সূফী শাস্ত্রে তার বিখ্যাত একটি দীওয়ান রয়েছে। কথিত আছে যে, এটি পুরোটাই স্বপ্নযোগে রচিত যা একটি ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর ঘটনা। আধ্যাত্মিক নানা বিষয় সম্বলিত এ দীওয়ানের নাম ‘আল মারেফাতুল এলাহিয়াহ’। রসূলুল্লাহ (স.)-এর প্রশংসাসূচক বহু কবিতা এতে স্থান পেয়েছে। উল্লেখিত ঘটনায় যে মিসরীয় শায়খের কথা বলা হয়েছে তার নাম উল্লেখ নেই। আসমান থেকে অবতীর্ণ ব্যক্তির নাম-পরিচয়ও নেই।

যে শহীদ জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েনি
শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে আরো একটি অভিনব ঘটনা ইতিহাসে উল্লেখিত হয়ে থাকে। একজন শহীদ, জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সুযোগও যার হয়নি অথচ রসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বেহেশতী বলেছেন। ঘটনার বিবরণ নি¤œরূপ :

ইমাম আহমদ (র.) হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, আবু হোরায়রা (রা.) প্রায় বলতেন, তোমরা এমন একজন লোকের নাম বল, যে তার সমগ্র জীবনে কখনো এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েনি, অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। লোকেরা না জানলে যখন তার কাছে জিজ্ঞাসা করতো তখন তিনি বলতেন, ঐ ব্যক্তির নাম ছিল ওছায়রাম ইবনে আবদুল্লাহ আল আশহাল।
আমের ইবনে সাবেত বলেন, আমি মাহমুদ ইবনে লাবীদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছে? তখন জবাবে তিনি বলেন, ওছায়রাম ইসলাম অস্বীকার করতো। কিন্তু ওহোদ যুদ্ধের সময় এক পর্যায়ে রসূলুল্লাহ (স.) ওহোদ প্রাঙ্গণের দিকে গমন করেন, তখন ওছায়রামের কাছে ইসলামের সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যায় এবং তখনই সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তরবারি ধারণ করে জেহাদ করার জন্য বের হয়ে পড়ে। ওহোদ রণাঙ্গনে গিয়ে সে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সে শাহাদত বরণ করে। সাহাবাগণ রসূলুল্লাহ (স.)-এর নিকট তার শহীদ হওয়ার কথা বললে তিনি বললেন, সে জান্নাতবাসী।

উপরে বর্ণিত দুটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় সামনে এসে যায়। যেমন : দ্বিতীয় ঘটনায় ওছায়রামের ইসলাম গহণের সাথে সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়া। ফলে তার জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ারও সুযোগ হয়নি। কিন্তু রসূলুল্লাহ (স.) ওছায়রাম সাহাবীকে জান্নাতি বলে সুসংবাদ দিয়েছেন। তার এ উচ্চ মর্যাদা লাভের কারণ অকৃত্রিমভাবে ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শাহাদত বরণ করা। ওহোদ যুদ্ধ ছিল রাসূল জীবনের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য জেহাদ। কাফেরদের বিরুদ্ধে রসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত সকল যুদ্ধ অভিযান ‘গাযওয়া’ ও ‘জেহাদ’। এসব জেহাদে শাহাদত বরণকারীদের আত্মা বেহেশতের সবুজ পাখি পাখি হয়ে বিচরণ করে, অন্যান্য জেহাদ যুদ্ধও নানা ক্ষেত্রের শহীদগণও কি অনুরূপ। জান্নাতের সবুজ হয়ে আরশের নিচে প্রদীপগুলোতে বসবাস করবে। প্রথমে উল্লিখিত মিসরীয় শায়খের ঘটনার যে ব্যাখ্যা আসমানী মানুষের বরাতে ইবনে ফারেয প্রদান করেছেন, তাতে শায়খের মৃত্যুর বর্ণনা রয়েছে কিন্তু কোনো জেহাদে বা রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করে শাহাদত বরণের কোনো উল্লেখ নেই, অথচ শায়খের লাশ প্রকা- সবুজ পাখিতে গিলে ফেলেছে।

বিশেষত, ইসলামের বিগত প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক বছরের ইতিহাসে যুগে যুগে দেশে দেশে জেহাদ রণাঙ্গন, বিপ্লব সংগ্রাম, আন্দোলনসহ বহু ক্ষেত্রে কত মুসলমান শাহাদত বরণ করেছে এবং অহরহ করছে তার ইয়ত্তা নেই, তারা সবাই কি জান্নাতের উড়ন্ত সবুজ পাখি? এরূপ প্রশ্ন অনেকে করে থাকেন।
আল্লাহর পথে বা উদ্দেশ্যে নিহতরাই শহীদ। আল্লাহর পথ বা উদ্দেশ্য বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। কোনো কোনো ভাষ্যকারের মতে, কোরআনের বহুস্থানে বাক্যাংশটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, যারা ন্যায়, সত্য ও পবিত্রতা রক্ষার জন্যে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর রাহে বা ধর্মযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তারা মৃত ননÑ বরং শহীদ ও অমর। ধর্মের মর্যাদা রক্ষার্থে মুসলমানদের অনেক সময় অধর্মের সম্মুখীন হতে হবে এবং আত্মরক্ষার্থে অনেক সময় তাদেরকে জেহাদ তথা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে, তাতে তারা বিচলিত হবে না। এক কথায়, আত্মোৎসর্গের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকাই খাঁটি মুসলিমের নিদর্শন। সুতরাং যারা এ মহৎ উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে নিহত হন তারাই শহীদ-অমর, তাদেরকে মৃত বলা যাবে না। কাজেই শহীদের মর্যাদা কোনো নির্দিষ্ট যুগ বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলে অনেক উলামায়ে কেরামের অভিমত।

তবে প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, সকল যুগের সকল শহীদকে এক কাতারে রাখার অর্থাৎ সকলকে সমমর্যাদা দানের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। যদি তাই হতো তাহলে, খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) তা ব্যাখ্যা করতেন এবং নানা শ্রেণীর শহীদের কথা ব্যক্ত করতেন না। বিষয়টি যথাস্থানে উল্লেখ করা হবে।
শহীদানে বদর
ভাষ্যকারগণের অধিকাংশের মতানুয়ায়ী, সূরা বাকারার উল্লেখিত আয়াতটি বদর যুদ্ধের শহীদান সম্পর্কে নাজেল হয়েছে। উল্লেখ্য, জেহাদ ফরজ হওয়ার পর বাতিল ও অসত্যের বিরুদ্ধে হক ও সত্যপ্রতিষ্ঠার প্রথম যুদ্ধ ছিল বদর। ইসলামের এ যুদ্ধে মক্কার কাফের মোশরেকদের মোকাবিলায় মুসলমানদের অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এক হাজার সশস্ত্র কাফের বাহিনীর বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ ৭০ জন নিহত হয় মুসলমানদের হাতে, পক্ষান্তরে মাত্র ৩১৩ জনের ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১৪ জন মুসলমান শাহাদত বরণ করেন বদর যুদ্ধে। মোহাজেরদের মধ্যে ৬ জন এবং আনসারগণের মধ্যে ৮ জন, মতান্তরে সর্বমোট ২২ জন। পরাজয়ের পর কাফেরদের ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। কিন্তু এ শোচনীয় পরাজয়ের পরও কাফেরদের ঔদ্ধত্ব্যের সীমা রইল না, তারা মুসলমানদের তিরস্কার করতে থাকে যে, মুসলমানদের যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তাদের মৃত্যু ঘটেছে। তাছাড়া এরূপও বলতে থাকে যে, নিহতরা অনর্থক মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্য মৃত্যু বরণ করেছেন।

এ সম্পর্কে তফসীরে খাজেনে বলা হয়েছে : ‘ইন্নাল কোফ্্ফারা ওয়াল মোনাফিকীনা কালু, ইন্নান্নাসা ইয়াক্তুলুনা আন্্ফুসাহুম জুলমান লি মারজাতিÑ মোহাম্মাদিন মিন গায়রি ফায়েদাতিন।’ অর্থাৎ Ñ কাফের ও মোনাফেকরা বলে, নিশ্চয় লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-এর সন্তুষ্টির জন্য অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে হত্যা করছে। এ সম্পর্কে আয়াত নাজেল হয়। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, লোকেরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অমুক মৃত্যু বরণ করেছে এবং তার দুনিয়ার সৌভাগ্য ও ভোগ বিলাসের অবসান ঘটেছে। এরূপ মন্তব্যের পর আয়াত নাজেল হয় এবং বলা হয় যে, আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তি মৃত নয়, জীবিত। আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে জীবিকা প্রদান করা হয়। বিভিন্ন হাদীসে অনুরূপ বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে এবং বদর যুদ্ধের শহীদগণের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী বদর যুদ্ধের শহীদানকে দাফন করা হয়। তাদের নামাজে জানাজা হয়েছিল কিনা, তাদের গোসল দেয়া হয়েছিল কিনা এবং নিহত অবস্থায় তাদের শরীরে যে পোশাক  ছিল তা-সমেত না কি নতুন বা অতিরিক্ত কাফন পরিয়ে দাফন করা হয়, এসব বিষয় বিস্তারিত জানা যায়নি। ওহুদ যুদ্ধের শহীদানের গোসল, জানাজা, কাফন ইত্যাদির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্পষ্ট নির্দেশাবলী রয়েছে। সম্ভবত, এ কারণেই কেউ কেউ বলে থাকেন যে, বদর যুদ্ধের সময় শহীদগণ সংক্রান্ত অনেক নির্দেশ নাজেল হয়নি যা ওহুদের সময় পর্যন্ত হয়েছিল। যদিও শহীদের মর্যাদার বর্ণনা রয়েছে।

সূরা আলে ইমরানে যে আয়াতগুলোর কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো কারো কারো মতে, বদর যুদ্ধের শহীদান সংক্রান্ত হলেও সর্বসম্মতভাবে সেগুলো ওহুদ যুদ্ধের শহীদান সম্পর্কিত। যার কিছুটা বর্ণনা পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে। যাতে আল্লাহর দরবারে শহীদদের উচ্চ মর্যাদা ও বেহেশতে তাদের অমর আত্মার বিস্ময়কর মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। সবুজ পাখি হয়ে তারা সেখানে অবস্থান করবে। আখেরাতে অর্থাৎ কবর বা বরজখ জীবনে ফি সাবিলিল্লাহ শহীদগণের উচ্চ শান-মর্যাদা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত হবে। এটি হচ্ছে শহীদদের একটি দিক। দুনিয়াতে নিহত বা শহীদ হওয়ার পর তাদের এক দৈহিক দিকও রয়েছে, যেটি দুনিয়াবাসীদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পরিদৃষ্ট হয়।

ওহুদ যুদ্ধের শহীদান
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের কথা। রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাজার সাহাবাসহ মদীনা হতে বের হন। পথিমধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই তার তিনশ’ মোনাফেকসহ আলাদা হয়ে যায়। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাতশ’ সাহাবী থেকে যান। অপর পক্ষে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কাফের বাহিনীতে ছিল প্রায় তিন হাজার নানা গোত্র ও মিত্রদের লোক। ওহুদ রণাঙ্গণে উভয় পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তা ওহুদ যুদ্ধ নামে খ্যাত। এটি ছিল মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কাফেরদের পাল্লা ভারি থাকে। পরিণতিতে কাফেরদের হাতে সত্তরজন মুসলমান শহীদ হন এবং নিহত কাফেরদের সংখ্যা ৩৩ কিংবা ২৩। শাওয়াল মাসের ৬ কিংবা ৭ তারিখে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধের বিবরণ দান করা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়, শহীদগণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করাই মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ শহীদগণের কাফন, দাফন, গোসল ইত্যাদি নানা বিষয় ওহুদ যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ওহুদ যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।

ওহুদে বিপুল সংখ্যক মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় দাফন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শহীদদের গোসল দিতেও নিষেধ করেছেন। ইতোপূর্বে কোনো শহীদকে গোসল দেয়া হয়নি বলে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু যদি জানা যায় যে, কেউ ‘জুনুবী’ অর্থাৎ অপবিত্র (যার উপর গাসল ওয়াজেব) অবস্থায় শহীদ হয়েছে তাহলে তাকে গোসল দেয়ার ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে। এমতাবস্থায় ইমাম আবু হানিফা (র.) ও ইমাম আহমদ (র.) গোসল দেয়া ওয়াজেব মনে করেন। ইমাম শাফেয়ী (র.) গোসল না দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি যুক্তি হিসেবে ‘গাসীলুল-মালায়িকা’ হজরত হানজালা ইবনে আবি আমের (রা.)-এর ঘটনার উল্লেখ করেন।

হজরত হানজালা (রা.)
ওহুদ যুদ্ধে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে সাহাবী হজরত হানজালা ইবনে আবি আমের (রা.)-এর সাথে। তার পিতার নাম ছিল আবু আমের রাহেব। আবু আমের প্রথমে রাহেব নামেই পরিচিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে আবু আমের ‘ফাসেক’ নামে আখ্যায়িত করেন, ফলে সে আবু আমের ফাসেক নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তার পূর্ণ নাম আবু আমের আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে সাইফী। জাহেলী যুগে সে আওস গোত্রের সর্দার- প্রধান নেতা ছিল। যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটে তখন ইসলামের প্রধান শত্রু হয়ে যায়। সে মক্কায় চলে যায় এবং কোরেশকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত ও উৎসাহিত করতে থাকে এবং সকলকে আশার বাণী শুনায় যে, তাকে দেখলে বনি আওসের সকল লোক তার প্রতি ঝুঁকে পড়বে এবং তার কাছে চলে আসবে। ওহুদ রণাঙ্গনে মোশরেক পক্ষ হতে সর্বপ্রথম আবু আমের ফাসেকই বের হয়। এবং তার সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়, কিন্তু তারা তাকে ফাসেক সম্বোধন করে তাকে প্রত্যাখ্যান করে তবে সে কাফেরদের পক্ষে ওহুদে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে।

আবু আমের ফাসেকের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন হজরত হানজালা। তিনি পিতার কোনো তোয়াক্কা না করে মুসলমানদের পক্ষে তুমূল যুদ্ধ করেন এবং গাসীলুল-মালায়িকা উপাধি লাভ করেন। ওহুদ রণাঙ্গনে তিনি আবু সুফিয়ানের মোকাবিলায় লড়াই করেন। এক পর্যায়ে তিনি আবু সুফিয়ানকে প্রায় কাবু করে ফেলেন এবং তাকে হত্যার উপক্রম। এ সময় শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ দেখল যে, আবু সুফিয়ান কঠিন অবস্থার সম্মুখীন তখন শাদ্দাদ তার সাহায্য করে এবং হানজালা (রা.)-কে শহীদ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হানজালা (রা.)-কে ফেরেশতারা গোসল দিচ্ছেন, তিনি সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা হানজালার গৃহে গমন করে অনুসন্ধান কর, ঘটনার রহস্য উদঘাটন কর কেন তার সাথে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। লোকেরা গিয়ে হানজালার স্ত্রীকে তার অবস্থা জিজ্ঞাসা করলে স্ত্রী জানায় যে, জেহাদের ঘোষণাকালে তিনি জুনুবী ছিলেন এবং ঘোষণা শ্রবণ করা মাত্র ঐ অবস্থায় তিনি চলে যান। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ফেরেশতা কর্তৃক তাকে গোসল দেয়ার আসল রহস্য এখানেই। হানজালা জুনুবী একথা মুসলমানদের জানা ছিল না, ফেরেশতারা তাকে গোসল দেন রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দৃশ্য অবলোকন করে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। তখন সবাই বুঝতে পারলেন হজরত হানজালা (রা.) কেন ‘গাসীলুল-মালায়িকা’ উপাধিত ভূষিত হলেন। সারকথা, ওহুদ যুদ্ধে ফেরেশতাদের অবতরণ ঘটে এবং তারা হজরত হানজালা শহীদকে গোসল দেন।

ওহুদ যুদ্ধে শহীদ সাহাবাগণের কাফনের ব্যাপারেও ইমামগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। সর্বসম্মত মত হচ্ছে, ওহুদের শহীদকে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের শরীরে আবৃত পরিচ্ছদ দ্বারাই দাফন করেছেন, কোনো নতুন কাপড় দেয়া হয়নি। মত ভেদের বিষয়টি হচ্ছে শহীদের পরিহিত রক্তাক্ত সেই পুরনো কাপড় দ্বারা কাফন দেয়া ওয়াজেব বলে ইমাম আবু হানিফার প্রসিদ্ধ মত, তার অপর মত হচ্ছে, সুন্নত যা ইবনে কাইয়েম বলেছেন। তবে ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ পুরনো কাপড়ে (পরিহিত কাপড়ে) কাফন দেয়া মোস্তাহাব মনে করেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে, ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আপন চাচা হজরত আমির হামজা (রা.) শহীদ হন, কাফেররা তার লাশের অবমাননা করে এবং লাশের ‘মুছলা’ অর্থাৎ বিকৃত করে। ‘সাইয়িদুশ শোহাদা’Ñ শহীদগণের সর্দার উপাধিতে ভূষিত হজরত হামজা (রা.)-এর বোন হজরত ছফিয়া (রা.) তার জন্য দু’খানা কাপড় তার কাফন হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।

কাফেররা তার লাশ বিকৃত করে পেট চিরে ফেলেছিল এবং তার কলিজা বের করেছিল, এজন্য তার শরীরে যে কাপড় ছিল তা কাফনের জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় হযরত ছফিয়া প্রেরিত দুটি কাপড়ের একটি হামজা (রা.)-এর কাফনে ব্যবহার করা হয় এবং অপরটি অন্য শহীদের কাফনে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এরূপ ওজর বা অপারগতা ব্যতীত শহীদের কাফন হিসেবে নতুন কাপড় ব্যবহার করা জায়েজ নয় বলে অনেক ইমামের মত। অনুরূপভাবে, শহীদগণের নামাজে জানাযা পড়ার ব্যাপারেও ইমামগণের মধ্যে মতভেদ বিদ্যমান। ইমাম আবু হানিফা (র.) ওয়াজেব মনে করেন এবং ইমাম মালেক (র.) ও ইমাম শাফেয়ী (র.) নিষেধ করেন। ইমাম আহমদ (র.)-এর দুটি মত রয়েছে। একটি মত অনুযায়ী, শহীদের জানাযার নামাজ পড়া যাবে না এবং অন্য মত হচ্ছে, পড়া এবং না পড়া উভয়ই জায়েজ।

বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত হামজা (রা.)-এর জানাযা ৭২ বার ভিন্ন বর্ণনায় ৭০ বার পড়েছেন। আর তা এভাবে : হযরত  হামজা (রা.)-এর লাশ চাদরে ঢেকে রাখা হলে হুজুর (সা.) প্রথম তার জানাযা পড়েন। অতঃপর একেকটি লাশ তার পাশে রাখা হতো এবং তার জানাযা পড়তেন। এভাবে তিনি ৭২টি লাশের মতান্তরে ৭০টি লাশের জানাযা পড়েন। ফলে হযরত হামজা (রা.)-এর জানাযাও ৭২-৭০ বার পড়া হয়। পরবর্তী সময়ে খলিফাদের আমলেও বিভিন্নযুদ্ধে শহীদদের জানাযার নামাজ পড়া হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রা.)-এর আমলে একটি যুদ্ধে ১৩০ জন শহীদের জানাযা পড়েন হযরত আমর ইবনুল আছ (রা.)।

অনুরূপভাবে শহীদদের তাদের নিহত হওয়ার স্থানেই দাফন করা সুন্নত। অপর স্থানে দাফন না করা। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে-

হযরত জাবের (রা.) বলেন, আমাদের পিতা ও মামার লাশ নদীপথে উটে করে আমরা মদীনায় নিয়ে যাই এবং আমাদের ইচ্ছা ছিল তাদের নিজস্ব কবরস্থানে দাফন করা। তখন এক ব্যক্তি আহ্বান করতে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সবার উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিয়েছেন যে, নিহতদের তাদের নিহত হওয়ার স্থানে নিয়ে গিয়ে সেখানেই দাফন করবে। আমরা হুজুর (সা.)-এর এ নির্দেশনার কথা শুনে লাশ দুটি আবার ঘটনাস্থলে নিয়ে যাই এবং সেখানেই দাফন করি।

এর ৪৬ বছর পরের ঘটনা। হযরত আমীর মোআবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে একবার লোকেরা আমাদের জানায় যে, আমাদের (জাবেরের) পিতার কবর খুলে গিয়েছে। খবর শুনে আমরা সেখানে গমন করি এবং দেখতে পাই যে, আমরা তাকে যেভাবে দাফন করে ছিলাম, ঠিক সেভাবেই লাশ অক্ষত রয়েছে, কিছুতেই কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা কবর ঠিকঠাক করে চলে আসি। এরপর নিয়ম হয়ে যায় যে, শহীদদের তাদের নিহত হওয়ার স্থানেই দাফন করা হতে থাকে। হযরত জাবের (রা.) বলেন যে, মনে হচ্ছিল আমার পিতা শায়িত রয়েছেন, সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি। লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, আপনি কাফনও দেখেছেন? তিনি বলেন, আমি একটি ডোরা চাদরে তার মুখে ঢেকে দিয়েছিলাম এবং পদযুগলে ঘাস চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আমরা দেখলাম চাদর ও ঘাস একই অবস্থায় বিদ্যমান। কোনোই পরিবর্তন হয়নি। অথচ তখন দাফনের ৪৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।

আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তিই শহীদের মর্যাদা লাভ করে এবং বরজখ তথা কবরে তার আত্মার প্রতি খোদায়ী নেয়ামত সৌভাগ্যের ধারা বর্ষিত হতে থাকে। কোরআন ও হাদীসে তার বর্ণনা রয়েছে। বাহ্যত, দুনিয়া থেকে দৈহিক মৃত্যুকে কবর জীবনে আত্মিক জীবন বলা হয়েছে এবং সেই জীবনের বৈশিষ্ট্যের কিছু কিছু নিদর্শন ওহুদ যুদ্ধের শহীদানের অমর আত্মার ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে এবং পরবর্তী শহীদী আত্মার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য বলা যায়। অমর শহীদী আত্মার অসীম মর্যাদার এ সর্বোচ্চ শ্রেণীর শহীদের মধ্যে মর্যাদা সীমিত হয়ে যায়, তাই ভিন্নভাবে শহীদী আত্মার জন্যও নানাস্তর নির্ধারণ করে অমর শহীদী আত্মার সাথে তুলনা করা হয়েছে।

রসূল (স.)-এর পতাকা
হিজরতের পর মদনী জীবনে রসূলুল্লাহ (সা.) যে কটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন সেগুলোতে ওহুদ ও হোনায়াইন ব্যতীত সব যুদ্ধেই মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়। কিছু মুসলমানের ভুলের জন্য ওহুদের বিজয় সাময়িকভাবে পরাজয়ের রূপ ধারণ করায় খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) আহত হন, কয়েকটি দান্দান মোবারক শহীদ হয়ে যায় এবং ৭০ জন মুসলমানকে শাহাদাত বরণ করতে হয়। হোনায়াইন যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যার আধিক্য দেখে কিছু মুসলমানের গর্ব-অহংকার আল্লাহর পছন্দ হয়নি, এটাই তাদের বিপর্যয়ের কারণ ছিল। তবে ৯টি বড় বড় যুদ্ধ অভিযানে যারা শহীদ হন তাদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে তিনশ’র অধিক হবে না। তাদের মধ্যে মোনাফেক কাফেরদের প্রতারণার শিকার হয়ে যারা শাহাদাত বরণ করেন তাদের সংখ্যা একশ’ অতিক্রম করবে না।

সীরাত লেখকদের বর্ণনা অনুযায়ী, রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর মদনী জীবনের দশ বছরে দশ লাখ বর্গ মাইল এলাকা জয় করেন এবং বিজিত এলাকার লোকদের তওহীদের কলেমা পড়িয়ে ছেরাতুল মোস্তাকিমে দাঁড় করান। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭৪ মাইল হিসেবে দশ বছর পর্যন্ত ‘ফতুহাত’ বা বিজয় মালার ধারা হিজরত হতে ওফাত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এ সমগ্র মুদ্দতে অগণিত লোক ইসলামের পতাকাতলে আসে। রসূলুল্লাহ (সা.) একটি মিল্লাত নির্মাণ করেন, একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান রচনা করেন। ইসলামকে মানবজাতির পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সামরিক ব্যবস্থা হিসেবে ও অসাধারণ সংস্কার সাধন করেন। আর পতাকা ছিল সর্বোত্তম পাহারা সংরক্ষক।

আরব দেশে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নামে পতাকার প্রচলন ছিল এবং যুদ্ধসহ নানাক্ষেত্রে পতাকা ব্যবহৃত হতো। বংশগত, গোত্রীয় এবং বিশেষভাবে জাতীয় প্রতীক হিসেবে পতাকার গুরুত্ব ছিল তাদের নিকট অপরিসীম। কোরেশের সামরিক পতাকার নাম ছিল ‘ওকাব’ যা আবু সুফিয়ানের নিকট থাকত। ইসলাম যুগেও পতাকার ঐতিহ্য প্রতীক অক্ষুণœ থাকে বরং এর গুরুত্ব অধিক বেড়ে যায়। কারণ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জন্য জেহাদ তথা ধর্মযুদ্ধের আদেশ হওয়ার পর যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার সময় ইসলামী পতাকার ব্যবহার অপরিহার্য করা হয় এবং পতাকা সমুন্নত রাখার মাধ্যমে তার মর্যাদা রণাঙ্গনেও কঠোরভাবে রক্ষা করা জরুরি মনে করা হতো। মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে রসূলুল্লাহ (সা.) পতাকার যে মর্যাদা প্রদান করেছেন, সাহাবাগণ তা যথাযথভাবে রক্ষা করে চলেছেন, এমনকি শাহাদতের সময়েও তা বিস্মৃত হননি। উল্লেখ্য, হুজুর (সা.) এর কালোবর্ণের একখানা বড় পতাকার নাম ছিল ‘আলওকাব’ কয়েকখানা ছোট ঝান্ডাও ছিল।

রসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুদ্ধ অভিযান প্রেরণকালে নিয়ম ছিল এই যে, সেনাদলের একজনকে আমীর বা সেনাপতি মনোনীত করতেন এবং তার হাতে ইসলামী পতাকা তুলে দিতেন ও জরুরি নির্দেশাবলী বলে দিতেন। তবে যেসব যুদ্ধে তিনি সশরীরে অংশগ্রহণ করতেন, রওয়ানা হওয়ার পূর্বে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শক্রমে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং কোনো একজনকে পতাকা বহনের দায়িত্ব অর্পণ করতেন। সাধারণত অভিযানের সময় সেনাপতির হাতে পতাকা প্রদান করতেন। তারা সর্বক্ষেত্রে পতাকার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থাকতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করার সময় রসূলুল্লাহ (সা.) পছন্দমত একজনকে পতাকা অর্পণ করতেন। মদীনার বাইরে গমন করলে একজনকে খলিফা বা প্রতিনিধি মনোনীত করতেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলামের প্রথম যুদ্ধে আনসার ও মোহাজেরীন ছাড়াও খজরজ এবং আওস গোত্রদ্বয়ের লোকেরাও ছিলেন। রসূলুল্লাহ (সা.) মোহাজেরীনের পক্ষে হযরত মোসয়ের ইবনে উমায়র (রা.)-কে পতাকা দান করেন এবং  খজরজ ও আওস গোত্রের পক্ষে যথাক্রমে হযরত হোবাব ইবনে মুনজের (রা.) এবং হযরত সাদ ইবনে মাআজ (রা.) পতাকা বহন করেন। পরবর্তীতে ওহুদ যুদ্ধেও দেখা যায়, রসূলুল্লাহ (সা.) হযরত মোসয়েব ইবনে উমায়র (রা.)-এর হাতে পতাকা দান করেন। অপরদিকে কোরেশ কাফেরদের পক্ষে পতাকা ছিল তালহার হাতে। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তাদের পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ঘটনা। ঘটনা ছিল এই যে, কোরেশদের পতাকাবাহী তালহা তার বাহিনীর কাতার হতে বের হয়ে প্রথা অনুযায়ী আহ্বান জানায়, হে মুসলমানগণ! তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যে আমাকে দোযখে পৌঁছে দেবে, অথবা খোদ আমার হাতে সে বেহেশতে চলে যাবে মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এটি ছিল তার টিটকারীমূলক আহ্বান। তার বক্তব্য শুনে হযরত আলী মোর্তাজা (রা.) বের হয়ে জবাব দিলেন, আমি প্রস্তুত আছিÑ একথা বলেই তিনি তরবারি দ্বারা আঘাত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তালহা লাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

তালহার এ শোচনীয় পরিণতির পর তার ভাই উসমান ঝা-া বহন করে এবং তার পেছনে পেছনে রণসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে আসছিল মহিলারা। উসমান উচ্চ কণ্ঠে এই কবিতা পাঠ করতে করতে আক্রমণ করে :
‘ইন্না আলা আহলিলুলিওয়ায়ি ইক্কান আন তোখাযযেবা আওতুনাদ্দেকা’ অর্থাৎ পতাকাবাহীর উচিত ধর্মকে রক্তে রঞ্জিত করা অথবা তা টক্কর খেয়ে ভেঙে যাবে।

হযরত আমীর হামজা (রা.) মোকাবিলায় অবতীর্ণ হন এবং তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করেন এবং বলে ওঠেন, আমি হাজাবীদের সাকীর (আবদুল মোত্তালেবের) পুত্র। ঘটনাটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, রণক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ (পরাজিত অবস্থায়) তাদের পতাকার মর্যাদা রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করত, যার প্রকৃত প্রমাণ ওহুদ যুুদ্ধের এ ঘটনা। অপরপক্ষে যুদ্ধের এক পর্যায়ে কিছু মুসলমানের ভুলের সুস্পষ্ট বিজয় ক্ষণিকের জন্য পরাজয়ে পরিণত হলে রসূলুল্লাহ (সা.) মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তার কয়েকটি দান্দান মোবারক শহীদ হয়ে যায় এবং অচিরেই রসূলুল্লাহ (সা.)-কে পেয়ে সাহাবাগণ তাকে ঘিরে ধরেন এবং তার সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান। আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। মুসলমানদের এ চরম বিপর্যয়ের সময়েও ইসলামের পতাকার মর্যাদা তারা সমুন্নত রাখেন এবং তা ভূলুণ্ঠিত হতে দেননি। রসূলুল্লাহ (সা.) তার জীবনে সর্বশেষ পতাকা অর্পণ করেন ওশামা ইবনে জায়দ (রা.)-এর হাতে।

পতাকা হাতে শহীদ হওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্ত : সিরিয়ার বালকা ভূখ-ের একটি স্থানের নাম মূতা। ইসলামের জেহাদ ইতিহাসে রসূল (সা.)-এর জীবনে মূতা অভিযান বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দুই লক্ষাধিক রোমক বাহিনীর মোকাবিলায় মাত্র তিন হাজার মুসলিম বাহিনীর এক অসম যুদ্ধে একে একে তিনজন সেনাপতির শাহাদাত বরণ অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেও তারা ইসলামের পতাকার মর্যাদা রক্ষায় শাহাদাতকে তুচ্ছ মনে করেছেন অথচ জীবনের শেষ মুহূর্তেও পতাকার মর্যাদা অবিচলভাবে সমুন্নত রেখেছেন। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ঘটনার বিবরণ নি¤œরূপ :

তখন রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াসের শাসনাধীন ছিল শ্যাম (সিরিয়া) ও বুসরা। সেখানকার শাসনকর্তা ছিলেন শোরাহবিল ইবনে আমর আল গাসসানি। রসূলুল্লাহ (সা.) হারেস ইবনে উমায়রকে কাসেদরূপে (দূত) একখানা পত্রসহ উক্ত শাসকের নিকট প্রেরণ করেন। দূত হত্যা করা ছিল ঘোরতর অন্যায়। শোরাহবিল রসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরিত দূতের প্রতি সামান্যতম সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা দূতকে হত্যা করে বসে। ইতিপূর্বে রসূলূল্লাহ (সা.)-এর কোনো দূতের প্রতি এহেন জঘন্য আচরণ কোথাও কেউ করেনি। গাসসানি কর্তৃক এ নৃশংস দূত হত্যার খবর শুনে রসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হন। এ ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু স্থানটি ছিল দূরের বিদেশ। তিনি হযরত জায়দ ইবনে হারেসা (রা.)-কে সেনাপতি মনোনীত করে বলেন, জায়দ শহীদ হলে তার স্থলাভিসিক্ত হবেন জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.)। তিনিও শহীদ হলে সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.)। তিন হাজার সৈন্যের নেতৃত্বে হযরত জায়দের এ বাহিনী যাত্রা করে। মাআন নামক স্থানে উপনীত হওয়ার পর মুসলিম বাহিনী জানতে পারে যে, বালকা ভূখ-ে খোদ হিরাক্লিয়াস এক লাখ সৈন্যসহ উপস্থিত এবং বিভিন্ন গোত্রের আরো এক লাখ সৈন্য অতিরিক্ত তার সাহায্যে সমবেত হয়েছে। মুসলিম বাহিনী এ খবর শুনে বিচলিত ও চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং দু’দিন পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকে। তারা চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে এ পরিস্থিতিতে কি উপায় অবলম্বন করা যায়। অনেকে মত প্রকাশ করলেন যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি রসূলুল্লাহ (সা.)-কে অবহিত  করা হোক। তিনি হয়তো  সাহায্য প্রেরণ করবেন অথবা কোনো  নির্দেশ প্রদান করলে সে মতে কাজ করা হবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) বললেন, হে লোক সকল! তোমরা শাহাদাত লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়েছ এবং আজ তাকে মন্দ মনে করছ। আমরা শক্তি ও সংখ্যার ওপর ভরসা করে যুদ্ধ করি না, ধর্মের জন্য যুদ্ধ করি। দুটি সাফল্যের মধ্যে একটি অবশ্যই আমরা লাভ করবÑ বিজয় অথবা শাহাদাত। আবদুল্লাহর আবেগময়, উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা মুসলমানগণের যুদ্ধের প্রেরণা বেড়ে যায় এবং সকলে আবদুল্লাহর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অতঃপর সবাই যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হন। বালকা ভূখ-ে পৌঁছার পর দেখা গেল শত্রুপক্ষ মাশারেফ নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছে। তাই মুসলিম বাহিনী মূতা নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে এবং এখানেই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

উভয় পক্ষে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। প্রথমে হযরত জায়দ ইবনে হারেসা (রা.) পতাকা বহন করেন, তিনি যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান। অতঃপর হজরত জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.) পতাকা ধারন করেন। যুদ্ধে তার ডান হাত কেটে গেলে তিনি বাম হাতে পতাকা সমুন্নত রাখেন। বাম হাত কেটে গেলে তিনি পতাকা  বুক ও বাহু দিয়ে সামলে রাখেন কিন্তু পতাকা মাটিতে পতিত হতে দেননি। এমন কী শাহাদাত বরণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল তিরিশ বছর। তার শহীদ হওয়ার পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) পতাকা  ধারণ করে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর সর্বসম্মতভাবে হযরত খালেদ ইবনে অলীদ  (রা.)  পতাকা বহন করেন এবং তার হাতে বিজয় সূচিত হয়Ñ যা ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরী ৮ম সালের জমাদিউল আউয়াল মাসে।
উল্লেখ্য, মূতা যুদ্ধ যখন চলছিল ঠিক সে সময় রসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় মসজিদে নববীতে উপস্থিত শাহাবায়ে কেরামকে যুদ্ধের নকশা বর্ণনা (ধারা বিবরণীর মতো) করছিলেন এবং কখন কে শহীদ হচ্ছেন এবং পরবর্তীতে কে পতাকা বহন করছেন অবিকল সব দৃশ্যের কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, আল্লাহর একটি তরবারি সাইফুন মিন সুয়াফিল্লাহ পতাকা বহন করেছে এবং আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেছেন। মদীনা থেকে যুদ্ধের প্রকৃত দৃশ্য বর্ণনা করা ছিল রসূলুল্লাহ (সা.)-এর এক বিস্ময়কর মোজেযা।

মূতা যুদ্ধে হযরত খালেদ ইবনে অলীদ (রা.)-এর হাতে ৯ খানা তরবারি ভেঙে যায়। কেবল একখানা তার কাছে অবশিষ্ট ছিল। এ যুদ্ধে তিনি সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) উপাধি লাভ করেন।

বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায়, মূতা যুদ্ধে হযরত জাফর ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর শরীরে তীর ও তরবারির নব্বইটিরও অধিক জখম ছিল। কিন্তু একটি জখমও সম্মুখ ভাগে ছিল না, পৃষ্ঠদেশেই ছিল সবক’টি। রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহতাআলা জাফর  (রা.)-কে পালক বিশিষ্ট দুটি বাহু দান করেছেন জান্নাতে,  সে যেখানে খুশি উড়ে বেড়ায়। হযরত জাফর (রা.)-এর উপাধি ছিল জিল জিনাহাইন (দুই বাহু বিশিষ্ট) এবং জাফর আইয়ার (উড়ন্ত জাফর)।

রসূল জীবনে তাঁর নির্দেশেই সাহাবাগণ রণাঙ্গনে অভিযানে পতাকা ব্যবহার  করতেন, পূর্ণভাবে পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতেন, শাহাদাতের সময়ও তা ভূলুণ্ঠিত হতে দেননি। তারা অপাত্রে, অপ্রয়োজনে যত্রতত্র পতাকা ব্যবহার করতেন না। পতাকা ব্যবহারে নীতিমালা অনুসরণ তার মর্যাদা রক্ষার অংশ। পরবর্তীকালেও যুগে যুগে দেশে দেশে সর্বত্র মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় জাতীয় এ ঐতিহ্য প্রতীকী নিদর্শনের মর্যাদা যথাযথ কঠোরভাবে রক্ষা করে আসছেন।

সর্বোত্তম যুগের শহীদ : রসূলুল্লাহু (সা.)-এর মক্কা-মদীনায় মাত্র ২৩ বছরের নবুওয়াত রেসালত যুগকে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলা হয়। পর্যায়ক্রমে পরবর্তী সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনের যুগ সর্বোত্তম। সুতরাং প্রথম যুগের ফিসাবিলিল্লাহ শহীদ গণ মানুষ হিসেবে যেমন সর্বোত্তম, শহীদ হিসেবেও তেমনি সর্বোত্তম। বিশেষভাবে আমরা রসূল (সা.) যুগের বিভিন্ন জেহাদ- অভিযানে শহীদ সাহাবায়ে কেরামের ওপর কিঞ্চিত আলোকপাত করেছি যারা বিভিন্ন গাজওয়া (যুদ্ধে) বা ‘সারিয়ায়’ (অভিযানে) শাহাদাত বরণ করেছেন। উল্লেখ্য, ‘সারিয়া’ সৈন্য বাহিনীর সেই দলকে বলা হয়, যাদের সৈন্য বাহিনী হতে আলাদা করে যুদ্ধের জন্য আক্রমণের জন্য প্রেরণ করা হয়। অতঃপর তারা মূল সৈন্য বাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের সংখ্যা একশ’ হতে পাঁচশ’ পর্যন্ত হয়। যদি পাঁচশ’-এর অধিক হয় তাদের ‘মানসার’ এবং আটশ’-এর বেশি হলে তাদের ‘জাইশ’ বলা হয়। এরূপ সারিয়ার সংখ্যা রসূল (সা.) জীবনে অর্থাৎ মদনী জীবনের ১০ বছরে (জেহাদ ফরজ হওয়ার পর) মতান্তরে ২৫, ২৭, ২৯ এমন কি ৬০ পর্যন্ত বর্ণিত হয়ে থাকে। সাতটি প্রধান যুৃদ্ধের নাম পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে রসূলুল্লাহু (সা.) স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তারই নেতৃত্বে ও নির্দেশে যুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং তিনি তাঁর পছন্দমত কোনো সাহাবীকে পতাকা, ঝা-া বহনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, যার কিছুটা বর্ণনা পূর্বেই প্রদত্ত হয়েছে। আরো স্মর্তব্য যে, সূরা বাকারার ১৫৪নং এবং সূরা আলে ইমরানের ১৬৯-১৭১নং আয়াতগুলোতে শহীদগণের যে উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে তারা সবাই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী, সর্বোত্তম যুগের শহীদ, তাদের মর্যাদা ও পরবর্তীকালের ‘ফিসাবিলিল্লাহ’ শহীদগণের নিয়ত, উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন কিনা তা যেমন প্রশ্নবোধক তাদের উচ্চ মর্যাদার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

শহীদের শ্রেণী বিভাগ : ১. হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রসূলুল্লাহু (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোন প্রকারের লোকদেরকে শহীদ মনে কর? উপস্থিত সকলে বললেন, যারা আল্লাহর পথে নিহত হন। রসূলুল্লাহু (স.) বললেন, এভাবে (হিসাব করলে) তো আমার উম্মতে শহীদের সংখ্যা একেবারে নগণ্য থেকে যাবে।

লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে শহীদ কে? জবাবে রসূলুল্লাহু (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে সে শহীদ, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করেছে সে শহীদ, যে ব্যক্তি তাউনে (কলেরা, মহামারি ইত্যাদি) ধৈর্যধারণ করেছে এবং তাউনে মৃত্যুবরণ করেছে সে শহীদ, যে ব্যক্তি পেটের রোগে মারা গিয়েছে সে শহীদ এবং যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মরেছে সে শহীদ। (মুসলিম)

২. হযরত আবু হোরায়রা (রা.) আরো বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহু (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি গৃহ হতে পতিত হয়ে চাপা পড়ে মারা যায় সে শহীদ। (ঐ)।
৩. হযরত জাবের (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহু (সা.) বলেছেন, ‘জাতুলজাম্ব’ বা নিমুনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ। আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ। যে মহিলা প্রসবকালে মারা যায় সে-ও শহীদ। (আবুদাউদ)
৪. হজরত সাঈদ ইবনে জাইদ (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহু (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের মাল-সম্পদ রক্ষায় মারা যায় অথবা দ্বীনধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় কিংবা গৃহবাসীদের রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায়Ñএরা সবাই শহীদ। (ঐ)

অর্থাৎ চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী কর্তৃক কেউ (কোনো মুসলমান) নিহত হলে অথবা দ্বীন-ধর্মের কথা বলতে গিয়ে নিহত হলে, কিংবা নিজের মাল-সম্পদ বা নিজের সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজনের পক্ষ হতে প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হলে এরা সবাই শহীদ হিসেবে গণ্য হবে। তবে শর্ত হচ্ছে এদের নিহত হওয়ার ফলে ‘দিয়্যত’ বা ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য হবে না, বরং ‘কেসাস’ অর্থাৎ এ হত্যার প্রতিশোধ (বদলা) প্রযোজ্য হবে।

হজরত ফোজালা ইবনে উবায়দ (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহু (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আমল (মৃতুর সাথে সাথে) খতম হয়ে যায়, কিন্তু মোরাবিত ফিসাবিলিল্লাহকে (সীমান্তরক্ষী)-এর সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত পৌঁছতে থাকে এবং সে কবরের বিভীষিকা হতে নিরাপদে থাকে। (আবু দাউদ ইবনে হিববান) মোরাবেত অর্থাৎ সীমান্ত রক্ষীর আরো নানা ফজিলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যুদ্ধে শহীদ হলে তো কথাই নেই, এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলেও সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। যোদ্ধাদের, তাদের সন্তান-সন্ততিদের এবং তাদের পরিবার-পরজনদের প্রতি নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করলেও অনেক পুণ্য (সওয়াব) লাভের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
http://islamicnews24.net/সবুজ-পাখি-হয়ে-বেহেশতে-উড/

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন