ইয়ারমুকের সীসাঢালা প্রাচীর
ইয়ারমুক প্রান্তরে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এটা এক মরণপণ সংগ্রাম।
রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নিপুণ সেনাপতি ম্যানোয়েল বা মাহান দুই লক্ষেরও অধিক সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ৪০ হাজার সৈন্যের এক ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর উপর। একদিন নয় দুদিন নয়, ৫ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে। রোমক সৈন্যদের পায়ে শৃঙ্খল লাগানো হয়েছে যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে না পারে। অর্থাৎ জিততে না পারলে আত্মবলি দেবে এই দুর্জয় পণ নিয়েই রোমকরা যুদ্ধে নেমেছে।
একদিন যুদ্ধ করতে করতে ইয়ারমুক বিজয়ের মূলস্তম্ভ মহাবীর খালিদ ইবন ওয়ালিদের হাত অবিরাম তরবারী চালনায় প্রায় অবশ হয়ে পড়ল। এটা দেখে হারেস ইবনে হিশাম প্রধান সেনাপতি আবু উবাইদাকে বললেন, “খালিদের তলোয়ারের হক যতখানি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী খালিদ করে দেখিয়েছেন। তাঁকে এবার আরাম দেয়া দরকার।”
হযরত আবু উবাইদা তাঁর কথায় সায় দিয়ে খালিদের সমীপবর্তী হয়ে তাঁকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বললেন। খালিদ তার উত্তরে বললেন, “আমি সব রকমে, সবদিকে থেকে চেষ্টা করে শাহাদাত লাভের আশা করি, আমার নিয়ত আল্লাহ তায়ালাই জানেন।” বলে তিনি আবার শত্রু ব্যুহে ঢুকে পড়লেন। দু’লক্ষাধিক রোমক সৈন্যের বিরুদ্ধে ৪০ হাজার মুসলিম সৈন্যের প্রত্যেকে এভাবেই লড়ে যাচ্ছে।
একদিকে এই যখন অবস্থা আহতদের কাতারে আর এক দৃশ্য। আবু জাহিম ইবনে হুজাইফা আহত নিহতদের সারিতে তাঁর চাচাতো ভাইকে খুঁজে ফিরছিলেন। তাঁর কাঁধের মশকে পানি। খুঁজতে খুঁজতে তিনি তাঁর ভাইকে পেয়ে গেলেন। সে তখন মুমূর্ষু। যন্ত্রনায় সে কাতরাচ্ছে। ইশারায় সে পানি চাইল। হুজাইফা তাঁকে পানি দিতে গেলেন। এমন সময় পাশেই আরেকজন মৃত্যু যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল। তারও পানি চাই। হুজাইফার ভাই পানি পান না করে পাশের হিশাম ইবন আবিল আসের কাছে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে যেতে বললেন। হুজাইফা যখন হিশামের কাছে পৌঁছলেন, তখন পাশের আর একজন মুমূর্ষু সাহাবী পানি পান করতে চাইলেন। হিশাম ইংগিতে প্রথমে তাঁকেই পানি দিতে বললেন। হুজাইফা যখন পানি নিয়ে পাশের সাহাবীর কাছে পৌঁছলেন, তখন তাঁর রূহ ইহজগত ছেড়ে চলে গেছে। হুজাইফা ফিরে এলেন হিশামের কাছে। কিন্তু হিশামও ততক্ষণে জান্নাতবাসী হয়েছেন। হুজাইফা ফিরে গিয়ে তাঁর চাচাতো ভাইকেও আর পেলেন না। ততক্ষণে শাহাদাত বরণ করেছেন তিনিও।
অদ্ভুত এ ত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব আর মমত্ববোধ। তাঁরা পরস্পরে মিলে এমন সীসার প্রাচীর গড়ে তুলতে পেরেছিলেন বলেই সেদিন মাত্র ৪০ হাজার সৈন্য ইয়ারমুক প্রান্তরে সমগ্র এশিয়ার সম্মিলিত খৃস্টান শক্তির বিজয়ের প্রাণান্ত প্রচেষ্টাকে শোচনীয় পরাজয়ের অতল পঙ্কিলে ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল।
আল্লাহ আমাদের এই সব সোনালী মানুষদের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন