তাবুক অভিযানে অনুপস্থিত তিন সাহাবির তাওবার কাহিনী
হযরত
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেনাপতিত্তে যে কয়টি যুদ্ধ বা
যুদ্ধাভিযান সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে তাবুক যুদ্ধাভিযান অন্যতম । যদিও প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতির কারণে এ যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সংঘটিত হয়নি।
কিন্তু তথাপি যুদ্ধের নির্ধারিত স্থান তাবুকে মুসলিম বাহিনীকে প্রস্তুতি নিয়ে ও সর্বাধিক
গুরুত্ত সদলবলে যেতে হয়েছিল । মক্কা বিজয়ের পর এটাই ছিল ইসলামের সর্বোশেষ বৃহত্তম যুদ্ধাভিযান । এই অভিযানের জন্য
সাহাবায়ে কেরামের কারো শারিরিক অনুপস্থিতির অনুমতি তো ছিলই না, অধিকন্তু প্রত্যেক সাহাবিকে সাধ্যমত সর্ব্বোচ্চ পরিমাণ সাহায্যও দেয়ার আহবান জানানো হয়েছিল । তাবুক অভিযানের
প্রাক্কালে যখন আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয় তখন হযরত ওমর (রাঃ) নিজের সমস্ত
অস্থাবর সমপত্তির আর হযরত আবু বকর (রাঃ)
সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছিলেন ।
কিন্তু তিনজন
সাহাবী এই যুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে বিনা ওজরে অনুপস্থিত ছিলেন । তারা হলেন কা’ব বিন মালেক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা বিন রাবি’ । এই তিনজন সাহাবি অপর কোন সাহাবির
এমনকি রাসুল (সাঃ)- এরও কখনো কোন অভিযোগ
বা সংশয় ছিল না । তাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় কখনো কোন খাদ
ছিলনা । তথাপি সর্ব্বোচ্চ গুরুত্তবহ এই অভিযানে তারা সম্পুর্ণ বিনা ওজরে অনুপস্থিত থাকেন
। এ সংক্রান্ত বিশদ ঘটনা স্বয়ং হযরত কা’ব
ইবনে মালেক বর্ণনা করেছেন । এই বর্ণনা নিম্নরুপঃ
কা’ব বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নেতৃত্তে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে,
তন্মধ্যে তাবুক ও বদর ছাড়া আর কোনটাতেই আমি অনুপসথিত থাকিনি । তবে বদর যুদ্ধে
যারা অনুপস্থিত ছিলেন তাদের কাউকে আল্লাহর আক্রোশের সম্মুখীন হতে
হয়নি । কেননা বদর যুদ্ধে আসলে রাসুল (সাঃ) এর উদ্দেশ্য ছিল
কুরাইশদের কাফেলাকে ধাওয়া করা । এরুপ করতে গিয়ে হঠা এক সময় যুদ্ধ বেধে যায় । আকাবার রাতে রাসুল (সাঃ) ইসলামের ওপর
দৃঢ়ভাবে টিকে থাকা এবং ইসলাম ও রাসুল (সাঃ) কে সাহায্য করার জন্য যে মোট ৭০ জনের
কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম । ঐ রাতটি আমার কাছে যুদ্ধের
চেয়েও প্রিয় ছিল ।
তাবুক যুদ্ধের সময় আমি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও সচ্ছল অবস্থায় ছিলাম । এ সময়
আমার কাছে দুটো সওয়ারী ছিল, যা এর আগে
কখনো ছিল না । রাসুল (সাঃ)-এর নিয়ম ছিল, যখনই কোন যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতেন, কখনো
পরিস্কারভাবে স্থান, এলাকা বা কোন দিকে যাওয়া হবে তাও পর্যন্ত জানাতেন না । কিন্তু
তাবুক যুদ্ধের সময়টা ছিল ভীষণ গরমের সময় । পথও ছিল দীর্ঘ এবং তার কোথাও গাছপালা,
লতাপাতা, ও পানি ছিল না । আর শত্রুর সংখ্যাও ছিল অধিক । তাই রাসুল (সাঃ)
মুসলমানদেরকে যুদ্ধের সকল প্রয়োজ়নীয় জ্ঞাতব্য বিষয় স্পষ্টভাবে জ়ানিয়ে দেন, যাতে
তারা ভালোভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে । এ সময় রাসুল (সাঃ) এর সহযোদ্ধার সংখ্যাও ছিল বিপুল । তবে তাদের নাম ধাম লেখার জন্য কোন
খাতাপত্র বা রেজিস্ট্রার ছিল না । এ যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত থাকতে চায় – এমন লোক একজনও
ছিল না । তবে সকল সাহাবী এও মনে করতেন যে, কেউ যদি অনুপস্থিত থাকে, তবে আল্লাহর
ওহী না আসা পর্যন্ত রাসুল (সাঃ) তা জানতে পারবেন না । রাসুল (সাঃ) যখন এ যুদ্ধের
প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, তখন ফল পেকে গিয়াছিল এবং ছায়া খুবই ভালো লাগতো । রাসুল
(সাঃ) ও তার সাথী মুসলমানগণ পূরো উদ্দমে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন । আমিও
প্রতিদিন ভাবতাম প্রস্তুতি নিব । কিন্তু কোন
প্রস্তুতিই নেয়া হতো না । এমনই দিন কেটে যেত । আমি নিজেকে
সান্তনা দিয়ে বলতাম, আমি তো যে কোন সময় প্রস্তুতি নিতে পারবো । ব্যস্ত হওয়ার দরকার
কি? এভাবে দিন গড়িয়ে যেতে থাকে । একদিন ভোরে তিনি মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে চলে
গেলেন । তখনো আমার প্রস্তুতি নেয়া হয়নি । আমি মনে মনে বললাম, ওরা চলে যায় যাক ।
আমি পথেই তাদেরকে ধরতে পারবো । তাদের রওনা হয়ে যাওয়ার পরের দিন আমি রওনা হতে
চাইলাম, কিন্তু দিনটা কেটে গেল, আমার রওনা দেয়া হয়ে উঠলো না । পরদিন সকালে আবার
ইচ্ছা করলাম । কিন্তু এবারও পারলাম না রওনা দিতে । এভাবে গরিমসির মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন কেটে গেল । ততক্ষণে মুসলিম বাহিনী অনেক দূরে
চলে গেছে । আমি কয়েকবার বেরিয়ে দ্রুত বেগে তাদেরকে ধরে ফেলার সংকল্প করেও পিছিয়ে
থাকলাম । আফসোস তখনো যদি কাজটা করে ফেলতাম । কিন্তু আসলে তা বোধ হয় আমার ভাগ্যে
ছিলনা । রাসুল (সাঃ) ও মুসলমানদের চলে যাওয়ার পর আমি যখন মদিনায় জনসাধারণের মধ্যে
বেরুতাম, তখন পথে ঘাটে মুনাফিক ও পিড়াব্যধীগ্রস্ত লোক ছারা আর কাউকে দেখতাম না । এ
পরিস্থিতিতে নিজেকে দেখে আমার খুবই দুঃখ লাগতো ।
রাসুল (সাঃ) তাবুক যাওয়ার পথে আমার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি । তবে
তাবুকে পৌছে জিজ্ঞেস করেন যে, কা’বের কি হয়েছে? বনু সালামার এক ব্যক্তি বললোঃ হে
রাসুলুল্লাহ! নিজের সম্পদের মায়া ও আত্মাভিমানের কারণে সে আসেনি । মুয়াজ ইবনে
জাবাল এ কথা শুনে বললেনঃ “ছি, কি একটা বাজে কথা তুমি বললে! আল্লাহর কসম, তার
সম্পকে আমরা কখনো কোন খারাপ কথা শুনিনি ।” রাসুল (সাঃ) উভয়ের বাক্য বিনিময়ের মধ্যে
চুপ করে থাকলেন ।
কা’ব ইবনে মালেক বলেনঃ যখন আমি জানতে পারলাম যে, রাসুল (সাঃ) আসছেন, তখন
ভাবলাম, এমন কোন মিথ্যে ওজর বাহানা করা যায় কিনা, যাতে আমি তার অসন্তোস থেকে রক্ষা
পেতে পারি । কিন্তু পরক্ষণেই এসব চিন্তা আমার দূর হয়ে গেল । আমি মনে মনে বললাম যে,
মিথ্যে ওজর দিয়ে আমি রেহাই পাব না । কারণ রাসুল (সাঃ) ওহীর মাধ্যমে জেনে ফেলবেন ।
কাজেই পুরোপুরি সত্য কথা বলবো বলে স্থির করলাম । রাসুল (সাঃ) পরদিন সকালে ফিরে এসে
মসজিদে নববীতে বসলে তাবুক যুদ্ধে যারা যায় নি তারা একে একে আস্তে লাগলো এবং প্রায়
৮০ জন নানা রকম ওজর বাহানা পেশ করে কসম খেতে লাগলো । রাসুল (সাঃ) তাদের ওজর মেনে
নিলেন, তাদের কাছ থেকে পুনরায় বায়য়াত নিলেন, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন
এবং তাদের গোপন বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করলেন । আমিও তার কাছে এলাম । আমি সালাম
দিলে তিনি ঈষৎ ক্রোধ মিশ্রিত মুচকি হাসিসহ চিঠিটা পড়ার সাথে সাথে আমি মনে মনে
বললাম, এ আর এক পরীক্ষা । আমি তৎক্ষনা্ত তা চুলোর মধ্যে নিক্ষেপ করলাম ।
এভাবে চল্লিশ
দিন কেটে গেলে রাসুল (সাঃ)–এর এক দূত আমার কাছে এসে বললোঃ রাসুল (সাঃ) তোমাকে
তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক হয়ে যাবার আদেশ দিয়েছেন । আমি বললামঃ ওকে
তালাক দেব নাকি? দূত বললেনঃ না, তালাক দিতে হবে না, তবে তার কাছে যাবে
না । আমার অন্য দু’জন সাথীকেও একই হুকুম দেয়া হলো । আমি আমার স্ত্রীকে বললামঃ তুমি
বাপের বাড়ীতে চলে যাও এবং আল্লাহর ফয়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর । হিলাল ইবনে
উমাইয়ার স্ত্রী রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেনঃ হে রাসুল! আমার সামী বুড়ো হয়ে গেছে
। তার কোন ভৃত্য নেই । আমি যদি তার দৈনন্দিন কাজ কর্ম করে তার সেবা করে দিই, তাতে
কি আপত্তি আছে? রাসুল (সাঃ) বললেন, আপত্তি নেই । তবে সে যেন তোমার কাছে না আসে ।
আমাকেও কেউ কেউ বললো যে, তুমি রাসুল (সাঃ) এর কাছে গিয়ে স্ত্রীর জন্য অনুমতি নিয়ে
এস, যেমন হেলালের স্ত্রী এনেছে । আমি বললামঃ না, আমি কোন অনুমতি আনতে যাব না ।
জানি না তিনি কি ভাববেন । কারণ হেলাল বিন উমাইয়া বুড়ো, আর আমি যুবক ।
এভাবে আরো দশটি দিন কেটে গেলে একদিন ফজরের নামায পড়ে অত্যন্ত বিষন্ন মনে
বসেছিলাম । সহসা সে একজন চিৎকার করে বলতে বলতে ছুটে আসতে লাগলোঃ “কা’ব ইবনে মালেক!
সুসংবাদ গ্রহণ কর ।” আমি তৎক্ষণাত সিজদায় পড়ে গেলাম । বুঝলাম, আমাদের মুসিবত কেটে
গেছে । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঐদিন ফজরের পর ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ আমাদের তওবা
কবুল করে নিয়েছেন । লোকেরা দলে দলে এসে আমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগলো । এরপর আমি
রাসুল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম । আমি দেখলাম, তিনিও আমার সুসংবাদে
আনন্দিত । আমি বললামঃ হে রাসুলুল্লাহ
(সাঃ)! আমার তওবা কবুলের জন্য শুকরিয়া সরুপ আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহ ও রাসুলের
পথে সদকা করে দিতে চাই । রাসুল (সাঃ) বললেনঃ সব নয়, কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দাও
। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ এবার আমাকে সত্য কথা বলার কারণে ক্ষমা
করেছেন । কাজেই এরপর বাকী জীবন আমি সরবদা সত্য কথাই বলতে থাকবো । আল্লাহ যেন আমাকে
মিথ্যা থেকে রক্ষা করেন ।
শিক্ষাঃ
(১) এ ঘটনার সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
সত্য কথা বলার নীতিতে অবিচল থাকতে হবে । চায় তাতে যত কঠিন পরীক্ষাই আসুক না কেন ।
(২) আল্লাহ মোনাফেকদেরকে পরীক্ষার সম্মুখীন করেন না বরং মুমিনদেরকেই কঠিন
পরীক্ষার সম্মুখীন করেন । এই তিন মুমিন ব্যতিত বাকী ৮২জন মিথ্যা ওজুহাত পেশ করলেও
তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় নি । কারণ তারা ছিল মুনাফিক । তাই আল্লাহ তাদেরকে
পরিসুদ্ধ করতে চান নি ।
(৩) ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্তের অধিকার রয়েছে কুরআন হাদীসের সীমার মধ্যে
নিষ্ঠাবান কর্মীদেরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন করা বা গুরুতর ভুল
কাজের জন্য শাস্তি দেয়ার । এসব ক্ষেত্রে আনুগত্যের পরিচয় দিয়ে এবং কোন দিক থেকে কু-প্ররোচনা
এলে তা উপেক্ষা করে পরীক্ষার কৃতকায হবার চেষ্টা করতে হবে ।
(৪) ইসলামী আন্দোলনের কোন পর্যায়ে
কারো কোন সাফল্য বা কৃতিত্ত প্রমাণিত হলে
তার জন্য যাতে অন্তরে গব ও অহমিকার সৃষ্টি না হয় সে জন্য সম্ভব হলে সদকা করা উত্তম
। আর সেই সাথে তওবা ইস্তেগফারও অব্যাহত রাখা উচিৎ ।
(৫) অলসতা ও সিদ্ধান্তহীনতা এই তিনজন মোজাহীদের জীবনে চরম সংকট সৃষ্টি
করেছিল । কাজেই অলসতা, গড়িমসি ও সিদ্ধান্তহীনতা সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন