বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিরুদ্ধে শত্রুতার পরিণাম


আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিরুদ্ধে শত্রুতার পরিণাম

হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুসা (আঃ) এর আমলে বনী ইসরাইল গোত্রে একজন নামকরা আলেম ছিলেন । তার নাম ছিল বালয়াম বাউরা । তিনি তাওরাতের হাফেয ও মুফাসসির ছিলেন এবং ইসমে আযম জানতেন । তার একটি বিশেষ মর্যাদা ছিল এই যে, আল্লাহর ইসমে আযম উচ্চারণ করে তিনি যে দোয়াই করতেন, তা আল্লাহ কবুল করতেন এবং এ বিষয়টি বণী ইসরাইল ও অন্যান্য গোত্রের লোকদের জানা ছিল ।

হযরত মুসা (আঃ) যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন বালয়াম বাউরা কিনানে বণী ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বাস করতেন এবং তাদের ও হযরত মুসা (আঃ) এর সংগে তার ভালো সম্পর্ক ছিল । কিন্তু হযরত মুসা (আঃ) এর ইন্তিকালের পর যখন তার ভাগ্নে হযরত ইউশা ইবনে নূন (আঃ) বণী ইসরাইলের শাসক ও খলীফা নিযুক্ত হন, তখন বালয়াম বাউরা তার সরকারের একটি উচ্চ পদ লাভের প্রত্যাশা করেন । কিন্তু হযরত ইউশা (আঃ) তা দিতে অসীকার করায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে পার্শ্ববর্তী মোশরেক রাজ্য বেলকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন । এই রাজ্যের রাজা তাকে বসবাসের জন্য একখন্ড জমি দান করেন এবং সেখানে তিনি বাড়ী বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন ।

ওদিকে হযরত ইউশা (আঃ) এর নেতৃত্যে বণী ইসরাইল পার্শ্ববর্তী ইল্লিয়া রাজ্য জয় করে বেলকা রাজ্যের সীমান্তে উপনীত হয় । বেলকার মোশরেক রাজ্য দখল করে সেখানে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে আদেশ দেন । তদানুসারে হযরত ইউশা বেলকা রাজ্যের মোশরেক রাজাকে ইসলাম গ্রহণ নতুবা আত্মসমর্পনের জন্য চরমপত্র দেন । বেলকার রাজা চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে হযরত ইউশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং তাতে হযরত ইউশার বাহিনী বিজয়ী হয় । বেলকার রাজার সৈন্যদের একাংশ নিহত হয় এবং অপরাংশ পালিয়ে যায় । এই অবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে উক্ত রাজা বালয়াম বাউরার শরণাপন্ন হয় । সে তার নিকট উপস্থিত হয়ে বলে যে, আমার এই বিপদের দিনে আপনার সাহায্য আমার একান্ত প্রয়োজন । আপনি আপনার আল্লাহর নিকট দোয়া করুন যেন আমরা ইউশার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করতে পারি এবং তাকে তাড়িয়ে দিতে পারি ।

বালয়াম বাউরা বললেন, হযরত ইউশা (আঃ) আল্লাহর নবী ও প্রিয় ব্যক্তি । তার বিরুদ্ধে দোয়া করা আমার পক্ষে ঘোরতর পাপের কাজ হবে । তাছাড়া এরুপ দোয়া কবুল হওয়ার আশা করা যায় না । আপনি বরঞ্চ ইসলাম গ্রহণ করুন । আপনার রাজ্য নিরাপদ থাকবে ।

রাজা ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো । সে বালয়াম বাউরাকে একদিকে হত্যার ভীতি প্রদরশন করতে লাগলো, অপরদিকে বালয়াম বাউরার স্ত্রীর কাছে গোপনে দূত পাঠিয়ে বিপুল অর্থ প্রদানের প্রলোভন দিতে লাগলো । বালয়াম বাউরা দেখলেন, তিনি আপনজনদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি কাফের রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের মুঠোর মধ্যে চরম অসহায় অবস্থায় পতিত হয়েছেন । এখানে রাজার বিপুল শক্তির মোকাবিলা করা তার সাধ্যাতীত । অপরদিকে অরথের প্রলোভনেও তিনি দিশাহারা হয়ে পড়লেন । তাই তিনি রাজাকে বললেন, আমাকে একদিন সময় দিন । রাজা তাকে সময় দিল । বালয়াম বাউরার নিয়ম ছিল, কোন বিষয়ে দোয়া করতে হলে প্রথমে আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইতেন । আল্লাহ তাকে সপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন অনুমতি দেয়া হলো কি না । একদিন সময় নিয়ে বালয়াম বাউরা আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলেনআল্লাহ তাকে সপ্নের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন যে, আমার নবীর বিরুদ্ধে কোন দোয়া গ্রহণযোগ্য নয় এবং এরুপ দোয়া করলে তোমার দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ হয়ে যাবে ।

বালয়াম বাউরা রাজাকে তার সপ্নের কথা জানালেন । রাজা তাকে বললেন, আপনাকে আরো একদিন সময় দেয়া গেল । আবার অনুমতি প্রারথনা করুন । বালয়াম বাউরা আবারো অনুমতি প্রারথনা করে ঘুমিয়ে গেলেন । এবার তাকে সপ্নে কিছুই জানানো হলো না । বালয়াম বাউরা কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেলেন । তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছেন এমন সময় রাজার দূত এসে তাকে আবার তাড়া দিল দোয়া করার জন্য । এই সময় শয়তান তাকে এই মর্মে  প্ররোচনা দিল যে, গত রাতে আল্লাহ যে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তাকে মৌন সম্মতি ধরে নেয়া যায় । তাছাড়া দোয়ার মাধ্যমে কাফের বাদশাকা বিজয়ী হতে সাহায্য করলেসে হয়তো তার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে এবং পরবর্তী সময়ে তাকে হেদায়েত করা সহজ হবে । অথচ তিনি একথা ভেবে দেখলেন না যে, আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে শত্রুতার আচরণ করা কত বড় মারাত্মক গুনাহর কাজ এবং এরুপ কাজ করে কোন বাতিল শক্তিকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করার আশা দুরাশা মাত্রতাছাড়া যে কাজ আল্লাহর কিতাবে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সপ্নের মাধ্যমে তার রদবদল হতে পারে না । আসলে দুনিয়াবী সার্থের মোহে অন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি এ দিকটি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি ।

বালয়াম বাউরা চিরাচরিত নিয়মে তার গাধার পিঠে চড়ে পাহাড়ের ওপর নির্মিত তার নির্জন ইবাদতখানায় রওনা হলেন রাজার পক্ষে দোয়া করার মতলবে । কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে যে, এই সময় আল্লাহর হুকুমে গাধাটির চলনশক্তি রহিত হয়ে যায় । বালয়াম বাউরা তাকে প্রহার করতে আরম্ভ করলে সে বাকশক্তি প্রাপ্ত হয় এবং বলে যে, তুমি যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছ, আল্লাহ আমাকে সেজন্য তোমাকে বহন করে নিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন । এই সময় রাজার লোকজনদের একটি বিরাট দল বালয়াম বাউরার সঙ্গে যাচ্ছিল । বালয়াম বাউরা অগত্যা সেই জায়গায় দাড়িয়েই দোয়া করলেন । কিন্তু তিনি যে দোয়া করলেন, তার মুখ দিয়ে ঠিক তার বিপরীত কথা তার অজান্তেই উচ্চারিত হতে লাগলো । তিনি বললেন “রাজাকে বিজয়ী কর ।” কিন্তু সবাই শুনতে পেল, যেন তিনি বলছেন “হযরত ইউশাকে বিজয়ী কর তাই রাজার লোকেরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে লাগলো । তারা বললো, ওহে বালয়াম, আপনি তো উলটা দোয়া করছেন । বালয়াম বললেন, আমি ঠিকই দোয়া করছিলাম কিন্তু আমার জিহবা এখন আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে । এই সময়ে বালয়াম বাউরার জিহবা হঠাৎ কুকুরের জিহবার মত লম্বা হয়ে বুকের ওপর ঝুলে পড়লো । কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে যে, শুধু জিহবা নয়, তার শরীরের ওপরের অরধাংশ কুকুরের মত হয়ে যায় এবং নিম্নাংশ মানুষের মত বহাল থাকে ।

এবার বালয়াম বাউরা বললো, আমার তো দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই বরবাদ হয়ে গেল । এখন তোমরা একটি কাজ কর । তোমরা তোমাদের সুন্দরী নারীদেরকে বণী ইসরাইলী সৈন্যদের মধ্যে লেলিয়ে দাও । এতে তারা ঐ নারীদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে এবং তাদের পরাজয় অবধারিত হবে । রাজা এই পরামর্শ অনুসারে কাজ করলো এবং সকল সুন্দরী যুবতীদেরকে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে দিল । বণী ইসরাইলী বাহিনী এই পরীক্ষায় কৃতকারয হতে পারলো না । তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হলো এবং তাদের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লো । ফলে বহু সংখ্যক সৈন্য মারা গেল এবং পরাজয়ের সম্মুখীন হলো । আল্লাহর নবী হযরত ইউশা (আঃ) এই অবস্থা দেখে সেনাবাহিনীর মধ্যে আল্লাহর ভীতি জাগিয়ে তুললেন এবং বেহায়া নারীগুলিকে ধরে ধরে হত্যা করলেন । সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃংখলা ও খোদাভীতি পুণরুজ্জীবিত হওয়ার পর তিনি পুণরায় সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ চালালেন । এবার তার বাহিনী জয়যুক্ত হলো এবং বেলকার রাজ্য থেকে মোশরেক রাজার রাজত্ত সমূলে উৎখাত করা হলো । বালয়াম বাউরা যুদ্ধে মারা না গেলেও তার কাছ থেকে ইসমে আযম কেড়ে নেয়া হলো এবং অতঃপর তার আর কোন দোয়া কবুল হতো না । আর তার দেহাকৃতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তা তার মৃত্যু পর্যন্ত বহাল রইল ।
(তাফসীরে খাজেন, কাসাসুল আম্বিয়া, তাফসীরে মায়ারিফুল)

শিক্ষাঃ
এই ঘটনা থেকে নিম্নলিখিত শিক্ষাসমূহ গ্রহণ করা যায়ঃ
(১) নিজের জ্ঞান গরিমা ও ইবাদত উপাসনার ব্যাপারে কারো গরবিত হওয়া উচিত নয় । কারণ শওয়তান ও খোদাদ্রোহী মানুষদের প্ররোচনায় বিপথগামী হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়, যদি আল্লাহ সাহায্য ও রহমত না করেন ।
(২) এমন পরিবেশ ও কারযকলাপ থেকে দূরে থাকা উচিৎ, যাতে ঈমান ও চরিত্র বিপন্ন হবার আশংকা থাকে বিশেষতঃ দুনিয়াবী সার্থের ক্ষতির কারনে উত্তেজিত হয়ে সৎ্লোকদের সৎসরগ ত্যাগ করে অসৎ ও বাতিলপন্থীদের সংসরগ গ্রহণ করা নিজের ঈমান ও চরিত্রকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার শামিল
(৩) কোন অবস্থাতেই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত লোকদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্যেষ পোষণ করা উচিত নয় । এক হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কোন প্রিয়জনের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে, তার বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করি
(৪) অসৎ ও পথভ্রষ্ট লোকদের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং তাদের নিমন্ত্রণ ও উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত । এ কাজ করেই বালয়াম বাউরা আল্লাহর গযবে পতিত হয়েছিল ।
(৫) অশ্লীলতা ও হারামের অনুসরণ গোটা জাতির ধবংস ও পতন ডেকে আনে ।
(৬) অসৎ কাজে ও অশ্লীলতায় প্ররোচনাদানকারীকে, চাই সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন, কঠোর হস্তে দমন করা কর্তব্য
(৭) আল্লাহর প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা, মেধা প্রতিভা এবং ক্ষমতা ও পদমর্যাদাকে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর দীনের ক্ষতি সাধনে ব্যবহার করা আল্লাহর গযবকে ডেকে আনার শামিল । এ ব্যাপারে সকলের সতর্ক থাকা উচিত ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন