লুকমান
হাকীমের কিসসা
হযরত
লুকমান হাকীম হযরত দাউদ (আঃ) এর সমসাময়িক একজন অত্যন্ত জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি ছিলেন
। পবিত্র কুরআনে তার নাম উল্লেখ করতঃ তার কতিপয় উপদেশ উদ্ধৃত করা হয়েছে । নবী না
হয়েও কুরআনে তার মত এত গুরুত্ত আর কোন ব্যক্তি পান নি । নবী বা রাসুল না হওয়া
সত্তেও তার কথাবারতা ও আচরণে নবীসুলভ বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সততা প্রতিফলিত হতো । এজন্য তিনি
লুকমান হাকীম নামে পরিচিত ছিলেন ।
হযরত
লুকমানের জন্মস্থান বা বংশ পরিচয় সংক্রান্ত কোন তথ্য নির্ভরযোগ্য
সূত্রে পাওয়া যায় না । বিভিন্ন বর্ণনা থেকে তার সম্পর্কে
শুধু নিম্নোক্ত তথ্য সমূহ জানা যায়ঃ
প্রথম
জীবনে তিনি সিরিয়ায় এক ধনবান ব্যক্তির অধীনে গোলামীর জীবন যাপন করেন । তারপর তার
মধ্যে অসাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে তার মনিব তাকে মুক্ত করে দেয় ।
গোলামী
জীবনের পূর্বে তিনি মেষ রাখাল ছিলেন বলে জানা যায়
। সেই সময় তার সমবয়সী আর এক রাখালও তার সাথে মেষ চরাতো । তাদের মধ্যে প্রগাঢ়
বন্ধুত্ত ছিল ।
পরবর্তীকালে
যখন হযরত লুকমান একজন হাকীম অরথাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন, তখন তার
সেই বাল্য বন্ধুটি একদিন তাকে একটি বিরাট জনসমাবেশে ওয়ায নসিহত করতে দেখে । সে
সমাবেশ শেষে তাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি কি সেই ব্যক্তি নও, যার সাথে আমি মাঠে
বকরী চড়াতাম । হযরত লুকমান বললেন, হা, তুমি
আমাকে ঠিকই চিনেছ । আমি বাল্যকালে বকরী চরাতাম । সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি এই মর্যাদা
কিভাবে অরজন করলে? তিনি বললেনঃ আমি চারটি সভাব দারা এই মর্যাদা লাভ করেছিঃ (১)
কখনো হারাম সম্পদ উপার্জন করিনি । (২) কখনো মিথ্যা বলিনি ।
(৩) কখনো আমানতের খেয়ানত করিনি । (৪) কখনো সময়ের অপচয় করিনি ।
অসাধারণ
বুদ্ধিমত্তা প্রসূত ও জ্ঞানদীপ্ত কথা ও করমকান্ডকে হিকমত বলা হয়ে থাকে । পবিত্র
কুরআনে ও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতে হযরত লুকমানের যে
সব হিকমত বর্ণিত হয়েছে, তার কিছু কিছু নিম্নে তুলে ধরা হয়েছেঃ
পবিত্র
কুরআনে বর্ণিত হিকমতের বাণীঃ-
নিজ
পুত্রকে প্রদত্ত উপদেশাবলী
(১)
হে বৎস! আল্লাহর সাথে কারো শরীক করো না । আল্লাহর সাথে শরীক করা একটি মারাত্মক
জুলুম ।
(২)
হে বৎস! তুমি যদি একটি তিলের মত ক্ষুদ্র আকার ধারণ কর, অতঃপর কোন পাথরের অভ্যন্তরে
অথবা আকাশের অপরে অথবা ভূগর্ভে আত্মগোপন
কর, তবুও আল্লাহ সেখান থেকে তোমাকে বের করবেন ।
(৩)
হে বৎস! তুমি নামায কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কর এবং এই
পথে যে বিপদ আপদের সম্মুখীন হও, তাতে ধৈরয ধারণ কর ।
(৪)
মানুষের সাথে আচরণের সময় মুখ বিকৃত করো না এবং পৃথিবীতে অহংকারের সাথে চলাফেরা করো
না । ধীরস্থিরভাবে চলাফেরা কর এবং অনুচ্চ কন্ঠে কথা বল ।
রেওয়ায়েত
থেকে প্রাপ্ত হিকমতের বিবরণঃ-
(১) হযরত
লুকমান যখন গোলামীর জীবন যাপন করতেন, তখন একই মুনিবের অধীন তার সাথে আরো একটি
গোলাম কর্মরত ছিল । একবার সেই গোলামটি মনিবের কোন
খাদ্যদ্রব্য চুরি করে খেয়ে ফেলে । মনিব উভয়কে দোষারোপ করেন এতে হযরত লুকমান ভীষণ
চিন্তিত হয়ে পড়েন । কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ
করবেন, তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন । অতঃপর মুনিবকে পরামর্শ দিলেন
যে, আপনি আমাদের দু’জনকে গরম পানি খাইয়ে দিন । এতে উভয়ের বমি হবে এবং যে প্রকৃত
চোর, তার পেট থেকে বমির সাথে ভক্ষিত জিনিষের অংশ বেরিয়ে পড়বে । মনিব তার পরামর্শ মত কাজ করলেন এবং হযরত লুকমান নির্দোষ সাব্যস্ত হলেন ।
এই
ঘটনা থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, কো ন মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে কারো চুপ করে বসে
থাকা উচিৎ নয় । তাৎক্ষনিকভাবে তার প্রতিবাদ করা উচিত এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করা উচিত ।
(২)
একবার হযরত লুকমানের মনিব তার বন্ধুর সাথে পাশা খেলে হেরে যায় । খেলার যে বাজী পূর্বাহ্নে নির্ধারিত হয়েছিল,
সে অনুসারে হয় তাকে তার সমস্ত সম্পদ বিজয়ী বন্ধুকে দিতে হবে, নতুবা পার্শ্ববর্তী নদীর সমস্ত পানি তাকে খেয়ে ফেলতে হবে । খেলায়
হেরে যাবার পর বন্ধুটি তার মনিবকে এই দুটি শর্তের
একটি অবিলম্বে পালন করার জন্য চাপ দিতে লাগলো । মনিব অতি কষ্টে তার বন্ধুর কাছ
থেকে একদিন সময় নিয়ে বাড়িতে চলে এল এবং লুকমানকে সমস্ত বিষয় খুলে বললো । লুকমান
একটু চিন্তা করেই তাকে বললেনঃ আপনি আমার বন্ধুকে এক কানাকড়িও দেবেন না । বরং নদীর
পানি খেয়ে ফেলার শর্তটাই পালন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করবেন ।
তবে তাকে বলবেন, প্রথমে সে যেন নদীর দু’পাশে বাধ দিয়ে দেয় । তা না হলে এক দিক দিয়ে
পানি খেয়ে ফেললে অন্য দিক থেকে নদীতে আরো পানি ঢুকে পড়বে । হযরত লুকমানের শিখানো
এই বুদ্ধিতে তার মুনিব বিপদ থেকে রক্ষা পেল এবং তার বন্ধু অবৈধভাবে বন্ধুর অর্থ আত্মসাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো । এতে খুশী হয়ে মনিব
তাকে মুক্তি দিলেন ।
এই
ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মানুষকে অন্যের জুলুম ও শোষণ থেকে বাচানোর জন্য যেখানে
শক্তি প্রয়োগের পথ বন্ধ, সেখানে কৌশল প্রয়োগ করতে হবে ।
(৩)
আর একদিন হযরত লুকমান হাকীমের মনিব তাকে আদেশ দিল যে, আমার জন্য একটি বকরী যবাই
করে তার দেহের সর্বোত্তম অংশ রান্না করে নিয়ে এস । হযরত
লুকমান বকরীর হৃদপিন্ড ও জিহবা রান্না করে আনলেন । পরদিন মনিব আবার নির্দেশ দিলেন
বকরীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট অংশ রান্না করতে । লুকমান আবারো হৃদপিন্ড ও জিহবা রান্না করে
খাওয়ালেন । মনিব জিজ্ঞাসা করলোঃ কি হে লুকমান! আজও দেখি, তুমি একই অংগ রান্না করে
এনেছ । একই অংগ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিভাবে হয়? হযরত লুকমান বললেনঃ যে
কোন জীবের জিহবা ও হৃদপিন্ডই তার প্রধান অংগ । এই দুটি যখন ভালো থাকে, তখন সেও হয়
উৎকৃষ্ট জীব । আর এ দুটি যখন খারাপ হয়, তখন সে হয় নিকৃষ্ট জীব ।
এই
ঘটনা থেকে প্রকারান্তরে হযরত লুকমান শিক্ষা দিলেন যে, মানুষের বেলায়ও এই কথা
প্রযোজ্য । সে যদি তার হৃদয় দিয়ে সৎ চিন্তা করে এবং জিহবা দিয়ে সৎ কথা বলে, পবিত্র
জিনিষ পানাহার করে, তবে সে সর্বোত্তম
প্রাণীতে পরিণত হতে পারে, নতুবা নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত হবে । বলা বাহুল্য, তার
এ হিকমতটি হাদীস ও কুরআনের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
(৪)
আর একদিন হযরত লুকমানের মনিব তাকে নির্দেশ দিল তার যমীনে তিল বপন করতে । হযরত
লুকমান চালাকী করে তিলের পরিবর্তে সরিষা বপন
করলেন । পরে যখন ফসল জন্মালো, তখন মনিব বললো, আমি তো তোমাকে তিল বপন করতে বলেছিলাম
। তুমি সরিষা বপন করলে কেন? হযরত লুকমান বললেনঃ আমি তো ভেবেছিলাম, সরিষা বুনলেই
তিল হবে । মনিব বললেনঃ তা কি করে হয়? তখন হযরত লুকমান বললেনঃ আপনি যখন সব সময় পাপ
কাজ করে উত্তম ফল বেহেশত পাওয়ার আশা করেন, তখন সরিষা বুনে আমি তিল পাওয়ার আশা করলে
দোষ কী? এ কথা শুনে মনিব চমকে উঠলো এবং নিজের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করলো ।
(৫)
আর একবার লুকমান হাকীম একটি জাহাজে আরোহন করে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিলেন । জাহাজে একজন
সওদাগর ও তার সাথে একটি বালক ভৃত্য ছিল । জাহাজ সমুদ্রের মাঝখানে গেলে তার উত্তাল
তরংগমালা দেখে বালকটি বিকট চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল । সে জীবনে আগে কখনো
সমুদ্র দেখে নি ।তাই সমুদ্রের মাঝখানে এসে সে ভয়ে কাদতে লাগলো । সওদাগর অনেক
বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন । কিন্তু কোনই লাভ হলো না । এই অবস্থা
দেখে লুকমান হাকীম সওদাগরের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাকে বললেন,‘আপনি বোধ হয়,
বালকটির কান্নাকাটি থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন ।
যদি কিছু মনে না করেন, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি । সওদাগর সানন্দে রাযী হলো ।
লুকমান বালকটিকে নিয়ে জাহাজের এক প্রান্তে চলে এলেন । তারপর তার কোমরে একটি রশি
দিয়ে শক্ত করে বাধলেন । অতঃপর তাকে সাগরের পানির মধ্যে ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ রশি ধরে
টেনে নিয়ে চললেন । বালকটি পানিতে পড়বার সময় গগণবিদারী একটা চিৎকার দিল । কিন্তু
তারপরই নিরবে হাবুডুবু খেতে লাগলো । কিছুক্ষণ পর লুকমান তাকে টেনে তুললেন এবং
সওদাগরের কাছে রেখে এলেন । এবার সে আর কান্নাকাটি করলো না । শান্ত হয়ে বসে থাকলো ।
সওদাগর বিস্মিত হয়ে লুকমানকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ অসম্ভবকে আপনি কিভাবে সম্ভব করলেন?
লুকমান বললেনঃ ব্যাপারটা কঠিন কিছু ছিল না । বালকটি সমুদ্র কখনো দেখেনি । তাই
সমুদ্রের ভয়াল চেহারা দরশনই তাকে ভয়ে দিশেহারা করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল । কিন্তু
যখন সে দেখলো, সমুদ্রের পানিতে পড়ে যাওয়া বা ডুবে যাওয়া আরো ভয়াবহ ব্যাপার । তখন তার কাছে
জাহাজে বসে সমুদ্র দেখা অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক কাজ বলে মনে হতে লাগলো ।
এ জন্যই সে এখন শান্ত । আমি বিষয়টা প্রথমেই বুঝে নিয়ে এই কৌশল প্রয়োগ করেছি ।
এই
ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, বিপদ দেখেই অস্থির হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় । মনে
রাখতে হবে যে, যে বিপদ এখন সামনে এসেছে ভবিষ্যতে তার চেয়েও বড় বিপদ আশা বিচিত্র
কিছু নয় ।
darun...jmon apni temoni apnar golpo...tnx
উত্তরমুছুন