বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণ


হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণ

হযরত সালমান ফারসী প্রথম জীবনে একজন অগ্নি উপাসক ছিলেন । পরে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং সরবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি পারস্যের ইসফাহান প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন । তার পিতা ছিলেন একজন বিত্তশালী গ্রাম্য মোড়ল । তিনি তাকে এত বেশী স্নেহ করতেন যে, তাকে বাড়ী থেকে কোথাও যেতে দিতেন না । তিনি জানান যে, এই সময়ে তিনি অগ্নি উপাসকদের ধর্মে গভীর দক্ষতা অরজন করেন । এক মুহুরতের জন্যও যাতে আগুন নিভতে না পারে- এভাবে কুন্ডলী জালিয়ে রাখতে তাকে দায়িত্ত দেয়া হয়েছিল ।

এ সময়ে ঘটনাক্রমে একটি জমি দেখাশুনার দায়িত্ত তার ওপর ন্যস্ত হয় । সেই জমি দেখতে তিনি পিতার অনুমতিক্রমে বাড়ির বাইরে যাওয়া আসা করতে লাগলেন । এই সময় তার যাওয়া আসার পথের পাশে একটি খৃষ্টান গীরজা তার নজরে পড়ে । লোকজনের হৈ চৈ শুনে কৌতুহল বশতঃ তিনি সেই গীরজার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন । সেখানে তাদের উপাসনা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং মনে মনে বলেন, অগ্নি উপাসকদের ধর্মের চেয়ে এই ধর্ম অনেক ভালো । ঐ দিন তার আর জমি দেখতে যাওয়া হলো না । তিনি সারাদিন গীরজায় কাটিয়ে দিলেন । গীরজার লোকদের কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই ধর্মের উৎস কোথায়? তারা জানালেন যে, সিরিয়ায় ।

এরপর তিনি তার পিতার কাজে ফিরে গেলেন । তার পিতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি সারাদিন কোথায় ছিলেন? সালমান গীরজার ঘটনা খুলে বলে দিলেন । সেই সাথে এ কথাও বললেন যে, ঐ ধর্ম তার কাছে ভালো লেগেছে । একথা শুনে তার পিতা বললেন, না বাবা, ঐ ধর্মই ভাল । এতে তিনি তাকে নিয়ে ভীত হয়ে পড়লেন এবং তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিলেন

এই সময় সালমান গোপনে গীরজায় খৃষ্টানদের নিকট খবর পাঠান যে, আপনাদের কাছে সিরিয়া থেকে কোন কাফেলা এলে আমাকে জানাবেন । কিছু দিন পর সিরিয়া থেকে একটা কাফেলা এল । তারা যথাসময়ে সালমানকে সে খবর জানালো । সালমান বলে পাঠালেন যে, এই কাফেলার কাজ যখন শেষ হবে এবং তারা সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেবে, তখন আমাকে জানাবেন । তারপর কাফেলার কাজ শেষে সদেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলে তা সালমানকে জানানো হলো । সালমান তৎক্ষনাত তার সীয় পিতার স্নেহের শিকল ভেংগে গোপনে তাদের সাথে সিরিয়ায় চলে গেলেন । সিরিয়ায় গিয়ে তিনি লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই ধরমাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তারা তাকে জানালো যে, গীরজার পাদ্রীই সবচেয়ে জ্ঞানী ।

সালমান পাদ্রীর নিকট হাজির হয়ে বললেনঃ আমি এই ধর্মের প্রতি আগ্রহী । আমি আপনার সহচর হয়ে আপনার সেবা করতে চাই এবং আপনার কাছ থেকে ধর্ম শিখতে ও উপাসনা করতে চাই । পাদ্রী সালমানকে সীয় গীরজায় থাকতে দিলেন এবং সালমান খৃষ্টধর্মে  দীক্ষা নিতে লাগলেন । এই সময় সালমান বুঝতে পারলেন যে, উক্ত পাদ্রী খুবই অসৎ । সে জনসাধারণের কাছ থেকে ছদকা আদায় করে এবং তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ না করে নিজে আত্মসাৎ করে । এভাবে সে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করে । সালমান এরপর থেকে তাকে ঘৃণা করতে লাগলেন এবং ঐ স্থান ত্যাগ করার সুযোগ খুজতে লাগলেন ।

এই পাদ্রী মারা গেলে খৃষ্টানরা তার শেষকৃত্য সমপন্ন করার জন্য সমবেত হলো । সালমান তাদেরকে বললেনঃ এই লোকটি চরম দুর্নীতিবাজ ছিল । সে তোমাদেরকে ছদকা দিতে উপদেশ দিত । কিন্তু নিজে তোমাদের দেয়া ছদকা গুলো আত্মসাৎ করতো । তারা সালমানকে বললোঃ তোমার এইসব অভিযোগ যে সত্য, তার প্রমাণ কি? তিনি এর প্রমাণ সরুপ তার জমা করা সাতটা সোনা রূপা ভরতি কলসি বের করে দেখালেন । তা দেখে সমবেত জনতা ক্রুদ্ধ সরে বললোঃ আমরা এ নরাধমকে কবর দেব না । তারপর তার লাশকে শূলে চড়ালো । তার ওপর পাথর ছুড়লো এবং তারপর একজন নতুন যাজক নিয়োগ করলো ।

নতুন যাজক ছিল একজন নিরেট সৎ লোক । পৃথিবীর ধন-সম্পদের প্রতি তার কোন লালসা ছিল না । সালমান কিছু দিন তার কাছে থাকলেন । তারপর তার মৃত্যু কাছাকাছি হলে সালমান তাকে বললেনঃ জনাব, আমি তো এতদিন এখানে কাটালাম । এখন আপনার পর আমি কোথায় কার কাছে যাবো বলে দিন ।
তিনি বললেনঃ বাবা! আমি যতটা খাঁটি ধর্মের অনুসারী ছিলাম, এখন তেমন আর কাউকে দেখি না । ভালো লোকেরা সব পরপারে পাড়ি জমিয়েছে । এখন যারা আছে, তাদের অধিকাংশই ধর্মকে খানিকটা বিকৃত করেছে, আর খানিকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছে । তবে মুসেলে একজন আছে খাটি ধর্মের অনুসারী । তুমি তার কাছে চলে যাও ।

সালমান মুসেলের যাজকের কাছে গেলেন । সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন । মারা যাওয়ার আগে তাকে নাসিবাইনের এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে গেলেনঅতঃপর সালমান নাসিবাইনে গেলেন । সেখানকার পাদ্রীর কাছে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন । মারা যাওয়ার সময় আম্মুরিয়ার আর একজন যাজকের সন্ধান দিয়ে গেলেন । সালমান আম্মুরিয়ায় চলে গেলেন ।

আম্মুরিয়ায় কিছুদিন থাকার পর সেখানকার যাজকও মারা গেলেন । মৃত্যুর প্রাক্কালে সালমান তার কাছে একজন সৎ যাজকের সন্ধান চাইলে তিনি বললেনঃ এখন আর আমার জানা মতে সঠিক ধর্মের অনুসারী কোন যাজক পৃথিবীতে জীবিত নেই । তবে একজন নতুন নবীর আবিরভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে । তিনি ইব্রাহীম (আঃ) এর দীনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন । তিনি আরব ভূমিতে আবিরভুত হবেন এবং দুই মরুর মাঝে খেজুরের বাগানে পরিপুর্ণ জায়গায় হিজরত করবেন । তিনি হাদিয়া নেবেন । কিন্তু ছদকা গ্রহণ করবেন না । তার দুই কাধের মাঝে নবুয়তের সীল থাকবে । তুমি যদি সেই দেশে যেতে পারো তবে যেও
আম্মুরিয়ায় হযরত সালমান অনেক ছাগল ভেড়া পুষতেন । তারই এক পাল ছাগল ভেড়া একদল আরব বণিককে দিয়ে তাদের সাথে তিনি আম্মুরিয়া থেকে আরব চলে গেলেন । ওয়াদিল কুরাতে তারা তাকে এক ইহুদীর নিকট বিক্রী করে দিল সালমান এই ইহুদীর খেজুরের বাগানে কাজ করতে লাগলেন । ঐ খেজুরের বাগান দেখে তিনি ভেবেছিলেন, এটাই সেই আখেরী নবীর আভিরভাব স্থান । তাই তিনি ইহুদীর কাছেই থাকতে লাগলেন ।

হযরত সালমান বলেনঃ “এই সময় একদিন মদীনা থেকে আমার ইহূদী মনিবের এক আত্মীয় এল । বনু কুরায়যা গোত্রীয় ঐ ইহূদী আমাকে কিনে নিয়ে মদীনায় চলে গেল । মদীনাকে দেখেই আমি চিনতে পারলাম যেন ওটা অবিকল আমার আম্মুরিয়ার ওস্তাদের বর্ণিত জায়গা । তাই আমি ওখানেই থাকতে লাগলাম । এই সময় মক্কায় রাসুল (সাঃ) নবুয়ত লাভ করেছেন বলে শুনলাম । তবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর জানতে পারলাম না । কিছুদিন পর তিনি মদীনায় হিযরত করে আসলেন ।

একদিন আমি খেজুর ভরতি গাছের মাথায় চড়ে আমার মনিবের জন্য কিছু কাজ করছি মনিব তখন আমার নিচে বসা ছিলেন সহসা তার এক চাচাতো ভাই এসে তাকে বললোঃ আল্লাহ কয়লার বংশধরকে ধবংস করুন । (আওস ও খাজরাজ এই দুই গোত্রের মায়ের নাম কয়লা । তাই কয়লার বংশধর বলতে ঐ দুই গোত্রকে বুঝানো হয়েছে ।) ওরা এখন মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির চারপাশে ভীড় জমিয়েছে লোকটি আজই এসেছে । আওস ও খাজরাজ মনে করে, সে নাকি এ যুগের নবী এবং সরবশেষ নবী । হযরত সালমান (রাঃ) বলেনঃ খেজুর গাছের ওপরে বসে আমি যখন এ খবর শুনলাম, তখন আনন্দে ও উত্তেজনায় এত বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি মনিবের ঘাড়ের ওপর পড়ে যাবো বলে আশংকা হচ্ছিল । অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে এসে ঐ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি কার কথা যেন বলছিলেন? অমনি আমার মনিব আমাকে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল । সে বললোঃ তোর তা দিয়ে কি দরকার? আমি বললামঃ কিছু না, কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞেস করেছিলাম ।
হযরত সালমান বলেনঃ এরপর আমি নিজের কাছে সঞ্চিত কিছু খাবার জিনিস নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় গোপনে কুবাতে রাসুল (সাঃ) এর কাছে উপস্থিত হলাম । তাকে বললামঃ আমি শুনেছি, আপনার সাথে অনেক দরিদ্র লোক রয়েছে । তাদের জন্য আমি কিছু ছদকা এনেছি । এই বলে উক্ত খাদ্য হাযির করলে তিনি সাহাবীদেরকে তা খেতে বললেন । কিন্তু নিজে খেলেন না । তখন আমি মনে মনে বললামঃ আম্মুরিয়ার যাজক যে তিনটে আলামতের কথা বলেছে, তার একটি পেয়ে গেলাম । অতঃপর আমি সেদিনকার মতো চলে গেলাম ।
আর একদিন আরো কিছু খাবার নিয়ে তা হাদিয়া হিসেবে পেশ করলাম । রাসুল (সাঃ) তা নিজেও খেলেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ালেন । এরপর আমি দিতীয় আলামতটিও পেয়ে গেলাম ।

এরপর যখন তিনি বাকীয়ুল গারকাদ নামক কবরস্থানে তার জনৈক সাহাবীর দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসছিলেম, তখন আমি তার কাছে উপস্থিত হলাম । সেই সময় রাসুল (সাঃ) এর গায়ে ঢিলে ঢালা পোশাক ছিল । আমি নবুয়তের মোহরটি দেখার জন্য তার ঘাড়ের ওপর চোখ বুলাতে লাগলাম । রাসুল (সাঃ) আমার চাহনির হাবভাব দেখে বুঝে ফেললেন এবং তার পিঠের ওপর থেকে চাদর উঠিয়ে ফেলে দিলেন । আমি তখন নবুয়তের মোহর দেখে চিনতে পারলাম । আমি মোহরটিতে চুমু খাওয়ার জন্য ঝুকে পড়লাম এবং কাদতে লাগলাম । রাসুল (সাঃ) আমাকে বললেনঃ সামনে এসো । আমি সামনে গিয়ে বসে পড়লাম । অতঃপর অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম ।

এরপর রাসুল (সাঃ) আমাকে ইহুদীর দাসত্ত থেকে মুক্ত হবার জন্য ৪০ আউন্স স্বর্ণ দিলেন । ঐ স্বর্ণ ইহুদীকে দিয়ে আমি মুক্তি লাভ করলাম । কিন্তু বদর ও ওহুদ যুদ্ধ আমার দাসত্তের আমলে সংঘটিত হয় । তাই আমি তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারিনি ।

শিক্ষাঃ

হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণের এই ঘটনা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ । এর সরব প্রধান শিক্ষা এই যে, মুহাম্মদ (সাঃ) ছাড়া পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরীত আর কোন নবীর শরীয়ত অবিকৃত অবস্থায় নেই । তাই ইসলাম ছাড়া আর কোন ধর্ম সঠিক ও নির্ভুল নয় । এই সত্য ও সঠিক দীনের সন্ধান লাভের জন্য হযরত সালমান ফারসী প্রথম দিন থেকেই অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন । আল্লাহ তার অক্লান্ত সাধনাকে সফল করেছেন । এভাবেই আল্লাহ তায়ালা সত্যের সন্ধানরত প্রত্যেক মানুষকেই সত্যের সন্ধান দিয়ে থাকেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন