বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৩

মিরাজের ঘটনা


মিরাজের ঘটনা

মিরাজ হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়ের, অলৌকিক ও শিক্ষামূলক ঘটনা । রাত্রে সংঘটিত হওয়ায় অনেকে একে সবপ্ন ভেবে বিভ্রান্ত হয়েছে । আসলে এটি একটি বাস্তব ঘটনা । রাসুল (সাঃ) সম্পূরন জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায় ফেরেশতাদের সাহচরযে মক্কা শরীফ থেকে প্রথমে বাইতুল মাকদাস এবং পরে সেখান থেকে সাত আসমান ও তারও উর্দ্ধের জগত পরিভ্রমণ করেন এই ঘটনা সম্পর্কে নিম্নে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনা সমূহের সমন্নিত বিবরণ উদ্ধৃত করা হচ্ছে ।

রাসুল (সাঃ) একদিন সকালে সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে বললেনঃ “গত রাতে আমার প্রতিপালক আমাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন । গত রাতে আমি যখন মসজিদুল হারামে ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন তিনজন ফেরেশতা আমার কাছে আসলেন । তারা আমাকে জাগিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যমযম কূয়ার নিকট রাখলেন । অতঃপর জীবরিল আমার গলা থেকে বুক পর্যন্ত চিরে ফেললেন এবং আমার বুক ও পেটের ভেতর থেকে সমুদয় বস্তু বের করলেন । তারপর নিজ হাতে যমযমের পানি দারা ধুয়ে আমার পেট পবিত্র করলেন । অতঃপর একটি সোনার পাত্র আনা হলো । ঐ পাত্র থেকে ঈমান ও হিকমত নিয়ে বুক ও গলার ধমনীগুলো পুর্ণ করলেন এবং জোড়া লাগিয়ে দিলেন । অতঃপর আমাকে মসজিদুল হারামের দরজায় আনা হলো । সেখানে জিবরীল আমাকে বহন করে নেয়ার জন্য খচ্চর সদৃশ বোরাক নামক একটি জন্তু পেশ করলেন জন্তুটি ছিল শেবত বরণের । আমি যখন তাতে আরোহণ করলাম, তখন তা এত দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো যে, তার পেছনের পা দুটি যেস্থানে স্পরশ করে, সেখান থেকে সামনের পা যেখানে পড়ে তার দূরত্ত দৃষ্টি সীমার দূরত্তের সমান । এভাবে তা আমাকে বিদ্যুৎবেগে নিয়ে বায়তুল মাকদাসে গিয়ে উপনীত হল । এখানে জিবরীলের ইংগিতে বোরাকটিকে মসজিদুল আকসার দরজার কাছে একটি বিশেষ জায়গায় বেধে রাখা হলো । বনী ইসরাঈলের নবীগণ এই মসজিদে নামায পড়তে এসে তাদের বাহনকে ঐ জায়গায় বেধে রাখতেন ।

অতঃপর আমি মসজিদুল আকসার ভিতরে প্রবেশ করে দু’রাকাত নামায পড়লাম । কোন কোন বর্ণনা অনুসারে, পূর্ববর্তী সকল নবীগণের ইমাম হয়ে জামায়াতে নামায পড়লাম । তারপর সেখান থেকে উর্ধজগতে আরোহণের প্রস্তুতি শুরু হলো । প্রথমে জিবরীল আমার সামনে দুটি পেয়ালা পেশ করলেন । এর একটিতে দুধ ও অপরটিতে মদ ছিল । আমি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করলাম এবং মদের পেয়ালা ফেরত দিলাম । তা দেখে জিবরীল বলেনঃ আপনি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করে সাভাবিক দিনকে গ্রহণ করেছেন । অতঃপর উর্ধজগতের ভ্রমণ শুরু হলো । আমাকে ও জিবরীলকে নিয়ে বোরাক আকাশের দিকে উড়ে চললো । আমরা আমরা প্রথম আসমানে পৌছলে জিবরীল দাররক্ষী ফেরেশতাদেরকে দরজা খুলে দিতে বললেন । রক্ষী ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেনঃ কে? জিবরীল উত্তর দিলেনঃ আমি জিবরীল । ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনার সংগে কে? জিবরীল উত্তর দিলেনঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । ফেরেশতারা পূণরায় জিজ্ঞাসা করলেনঃ তিনি কি আল্লাহ তায়ালার নিমন্ত্রন পেয়ে এসেছেন? জিবরীল বলেনঃ অবশ্যই । ফেরেশতারা দরজা খুলতে খুলতে বললেনঃ এমন ব্যক্তির আগমন মোবারক হোক । আমরা যখন প্রথম আকাশে প্রবেশ করলাম, তখন প্রথমেই হযরত আদম (আঃ) এর সাথে দেখা হলো । জিবরীল আমাকে বললেনঃ ইনি আপনার পিতা আদম আলাইহিস সালাম । আমি তাকে সালাম করলাম । তিনি আমার সালামের উত্তর দিয়ে বললেনঃ সাগতম, হে সম্মানিত পূত্র ও সম্মানিত নবী । অতঃপর দিতীয় আসমান পর্যন্ত পৌছলাম । এখানে প্রথম আসমানের মত প্রশ্নোত্তরেরপালা অতিক্রম করে দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম । সেখানে হযরত ইয়াহিয়া ও ঈশা (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলো । জিবরীল আমাকে তাদের উভয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আপনিই আগে সালাম করুন । আমি সালাম করলে তারা উত্তর দিয়ে বললেনঃ “ সাগতম, হে সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত নবী ।” অতঃপর তৃতীয় আসমানে পৌছলে পূর্বের মত ঘটনাই ঘটলো এবং সেখানে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলো । জিবরীল আমাকে বললেনঃ আপনিই আগে সালাম করুন । আমি সালাম করলে ইউসুফ (আঃ) সালামের জবাব দিয়ে বললেনঃ “সাগতম, হে সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত নবী ।” অতঃপর চতুরথ আসমানে একই রকমের প্রশ্নোত্তরের পর্ব অতিক্রম করে হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলো । অতঃপর পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আঃ) এবং ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আঃ) এর সাথে একইভাবে সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হলো । কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) এর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার চোখ আশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো । আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনার এই অসাধারণ মর্যাদার জন্য আমার ঈরষা হচ্ছে যে, আপনার উম্মত আমার উম্মতের তুলনায় বহু গুণ বেশী বেহেশতবাসী হবে অতঃপর পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব অতিক্রম করে আমরা যখন সপ্তম আকাশে পৌছলাম, তখন সেখানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলো । তিনি সেখানে বাইতুল মা’মুরের দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসেছিলেন । এই বাইতুল মা’মুরে প্রতিদিন সত্তর হাজার নতুন নতুন  ফেরেশতা প্রবেশ করেন । তিনি আমার সালামের জবাব দিয়ে বললেনঃ “সাগতম, হে আমার সম্মানিত সন্তান এবং সম্মানিত নবী ।” অতঃপর সেখান থেকে আমাকে সিদরাতুল মুন্তাহায় নিয়ে যাওয়া হলো ।

অতঃপর আল্লাহ আমাকে সম্বোধন করে হুকুম দিলেন যে, আপনার ও আপনার উম্মতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হলো । অতঃপর আমি নিচের দিকে নামতে শুরু করলামপথিমধ্যে হযরত মূসা (আঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলো । তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই মিরাজের সফরে আপনি কি উপঢৌকন পেলেন? আমি বললামঃ ৫০ ওয়াক্তের নামায । তিনি বললেনঃ আপনার উম্মত এই ভারী বোঝা বহন করতে পারবে না । সুতরাং আপনি আবার ফিরে যান এবং আরো কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানান । কেননা আমি আপনার পূর্বে নিজের উম্মতকে পরীক্ষা করেছি । এ কথা শুনে আমি আল্লাহর দরবারে ফিরে গেলাম এবং মিনতি জানানোর পর ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো । অতঃপর মূসার কাছে আসলে তিনি পুণরায় বললেন, এখনো অনেক বেশী রয়েছে । আবার যান এবং আরো কমিয়ে আনুন । আমি আবার গেলাম । এবারও আরো ৫ ওয়াক্ত কমানো হলো । অতঃপর মূসার পীড়াপীড়িতে আবার যাই এবং আবার ৫ ওয়াক্ত কমিয়ে আনি । এভাবে কয়েকবার গিয়ে কমাতে কমাতে যখন মাত্র ৫ ওয়াক্ত বাকী রইল, তখনও মূসা আমাকে বললেন, আমি বনী ইসরাইলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আপনার উম্মত ৫ ওয়াক্তও সহ্য করতে পারবে না । সুতরাং আবার যান এবং কমিয়ে আনুন । এবার আমি বললাম,“ এখন আর আবেদন করার অবকাশ নেই । কেননা প্রতিবার ৫ ওয়াক্ত কমানো হয়েছে । এবার গেলেও হয়তো ৫ ওয়াক্ত কমানো হবে । তখন আমার হাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না । আমি এখন পুণরায় কমানোর আবেদন জানাতে লজ্জা বোধ করছি ।”

বুখারী শরীফের রেওয়ায়েতে আরো বলা হয়েছে যে, শেষ বারেও রাসুল (সাঃ) আল্লাহর কাছে যান এবং বলেন, হে প্রতিপালক! আমার উম্মতের শরীর, মণ, শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি খুবই দুরবল । অতএব আমার প্রতি এ নির্দেশকে আরো হালকা করে দিন । তখন আল্লাহ তায়ালা বললেনঃ হে মুহাম্মদ! রাসুল (সাঃ) জবাব দিলেনঃ হে প্রভু, আমি হাযির । আল্লাহ বললেনঃ আমার নির্দেশের কোন রদবদল হয় নাআমি তোমাদের প্রতি যা ফরয করেছিলাম, তা উম্মুল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে । প্রত্যেক সৎ কাজের নেকী দশগুণ । উম্মুল কিতাব বা লওহে মাহফুজে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লেখা থাকলো । শুধু তোমার ও তোমার উম্মতের জন্য তা ৫ ওয়াক্ত করা হলো । এরপর তিনি নেমে এলেন এবং নিজেকে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদুল হারামে উপনীত দেখতে পেলেন ।

শিক্ষাঃ মিরাজের ঘটনার শিক্ষা অনেক । এখানে তার মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা তুলে ধরেছিঃ

(১) নামায যে ইসলামী ইবাদতগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ, তা এই ঘটনা থেকে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে । আল্লাহ অন্যান্য সকল ইবাদত ফরয করার জন্য একটি ওহী নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেছেন । কিন্তু নামায ফরয করার জন্য কুরআনে ১১৩ বার নির্দেশ দেয়া সত্তেও তাকে যথেষ্ট মনে করেননিবিশেষভাবে দাওয়াত দিয়ে রাসুল (সাঃ) কে নিজের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিয়ে এই পাচ ওয়াক্ত নামায এমন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ফরয করলেন যে, প্রত্যেক ওয়াক্তের নামায দশটি ওয়াক্তের সমান বলে ধারণা দেয়া হলো । যাতে এর একটি ওয়াক্তও কেউ তর্ক করার সাহস না করা ।

(২) রাসুল (সাঃ) সরবশ্রেষ্ট নবী হওয়া সত্তেও তার পূর্ববর্তী সকল নবীকে প্রথম সালাম করেছেন । এ দারা ইসলামের এই শিক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে যে, কোন জায়গায় আগে থেকে উপস্থিত ব্যক্তি এবং পরে আগত ব্যক্তির মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তিরই কর্তব্য প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে সালাম করা, চাই মর্যাদার দিক দিয়ে যিনিই শ্রেষ্ঠ হোন না কেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন