শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১২

প্রাচীনকালে আরবে মেয়েদের জীবিত কবর দেবার কাহিনী এবং ইসলামের মেয়েদের মর্যাদা

প্রাচীনকালে আরবে মেয়েদের জীবিত কবর দেবার কাহিনী এবং  ইসলামের মেয়েদের মর্যাদা

প্রাচীনকালে আরবে মেয়েদের জীবিত কবর দেবার এ নিষ্ঠুর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এর বিভিন্ন কারণ ছিল। এক , অর্থনৈতিক দুরবস্থা । এই দুরবস্থার দরুন লোকেরা চাইতো খাদ্যের গ্রহণকারীর সংখ্যা কম হোক এবং তাদের লালন পালনের বোঝা যেন বহন করতে না হয়। পরবর্তীকালে অর্থ উপার্জনে সহায়তা করবে এই আশায় ছেলেদের লালন পালন করা হতো। কিন্তু মেয়েদের ছোটবেলায় লালন পালন করে বড় হয়ে গেলে বিয়ে দিয়ে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে , এ কারণে মেরে ফেলে দেয়া হতো। দুই , দেশের আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে সাধারণনিরাপত্তাহীনতার কারণে এটা মনে করে পুত্রসন্তানের প্রতিপালন করা হতো যে , যার যত বেশী ছেলে হবে তার তত বেশী সাহায্যকারী হবে। অন্যদিকে গোত্রীয় সংঘর্ষ ও যুদ্ধের সময় মেয়েদের সংরক্ষণ করতে হতো এবং তারা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোন কাজেই লাগতো না। তিন , আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে সাধারণ দুরবস্থার কারণে শত্রুগোত্ররা পরস্পরের ওপর আতর্কিত হামলা করার সময় প্রতিপক্ষ শিবিরের যতগুলো মেয়েকে হামলাকারীরা লুটে নিয়ে যেতো , তাদেরকে বাঁদী বানিয়ে রাখতো অথবা কোথাও বিক্রি করে দিতো ।



এসব কারণে আরবে কোথাও সন্তান প্রসবকালেই মায়ের সামনেই একটি গর্ত খনন করে রাখা হতো। মেয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তখনই তাকে গর্তে ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হতো । আবার কোথাও যদি মা এতে রাজী না হতো বা তার পরিবারের কেউ এতে বাধ সাধতো তাহলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাপ কিছুদিন তাকে লালন পালন করতো। তারপর একদিন মরুভূমি , পাহাড় বা জংগলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে কোথাও তাকে জীবিত কবর দিয়ে দিতো। এই ধরনের রেওয়াজ আরবের বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত ছিল । এ ক্ষেত্রে শিশু কন্যাদের সাথে কেমন নির্দয় ব্যবহার করা হতো তার একটি কাহিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক সাহাবী একবার তাঁর কাছে বর্ণনা করেন। সুনানে দারামির প্রথম অধ্যায়ে এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার জাহেলী যুগের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন : আমার একটি মেয়ে ছিল। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো । তার নাম ধরে ডাকলে সে দৌড়ে আমার কাছে আসতো ।একদিন আমি তাকে ডাকলাম। তাকে সাথে করে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পথে একটি কূয়া পেলাম। তার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে কূয়ার মধ্যে ফেলে দিলাম। তার যে শেষ কথাটি আমার কানে ভেসে এসেছিল তা ছিল , হায় আব্বা ! হায় আব্বা ! একথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেঁদে ফেললেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে একজন বললেন : ওহে , তুমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শোকার্ত করে দিয়েছো । তিনি বললেন : থাক তোমরা একে বাধা দিয়ো না। যে বিষয়ে তার কঠিন অনুভূতি জেগেছে সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতে দাও। তারপর তিনি তাকে বললেন : তোমার ঘটনাটি আবার বর্ণনা করো। সেই ব্যক্তি আবার তা শুনালেন । ঘটনাটি আবার শুনে তিনি এত বেশী কাঁদতে থাকলেন যে , চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে গেলো । এরপর তিনি বললেন জাহেলী যুগে যা কিছু করা হয়েছে আল্লাহ তা মাফ করে দিয়েছেন। এখন নতুন করে জীবন শুরু করো।

 
একথা মনে করা ভুল হবে যে , আরববাসীরা এই চরম অমানবিক কাজটি কদর্যতার কোন অনুভূতিই রাখতো না। কোন সমাজ যত বেশী বিকৃতই হোক না কেন তা কখনো এই ধরনের জুলুম ও অমানবিক কাজকে একেবারেই অন্যায় মনে করবে না , এমনটি কখনই হতে পারে না। তাই কুরআন মজীদে এই কাজটির কদর্যতা ও দূষণীয় হওয়া সম্পর্কে কোন লম্বা চওড়া ভাষণ দেয়া হয়নি। বরং কতিপয় লোমহর্ষক শব্দের মাধ্যমে কেবল এটুকু বলেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে , এমন এক সময় আসবে যখন জীবিত পুঁতে ফেলা মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে , কোন দোষে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল ৷ আরবের ইতিহাস থেকে ও জানা যায় , জাহেলী যুগে অনেক লোকের এই রীতিটির কদর্যতার অনুভূতি ছিল। 

তাবারানীর বর্ণনা মতে কবি ফারাযদাকের দাদা সা'সা ' ইবনে নাজীয়াহ আলমুজাশেই রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করে, যে আল্লাহর রসূল ! আমি জাহেলী যুগে কিছু ভালো কাজও করেছি। এরমধ্যে একটি হচ্ছে , আমি তিনশ ষাটটি মেয়েকে জীবিত কবর দেয়া থেকে রক্ষা করেছি। তাদের প্রত্যেকের প্রাণ বাঁচাবার বদলে দু'টি করে উট বিনিময় মূল্য হিসেবে দিয়েছি। আমি কি এর প্রতিদান পাবো ৷ জবাবে তিনি বলেন : তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে এবং সে পুরস্কার হচ্ছে , আল্লাহ তোমাকে ইসলামের নিয়ামত দান করেছেন।
 
আসলে এটি ইসলামের একটি বিরাট অবদান । ইসলামের কেবলমাত্র আরবের এই নিষ্ঠুর জঘন্য প্রথাটি নিমূল করেনি বরং এই সংগে মেয়ের জন্ম যে একটি দুর্ঘটনা এবং অনীচ্ছা সত্ত্বেও একে গ্রহণ করে নিতে হয় এই ধরনের চিন্তা ও ধারণারও চিরতরে অবসান ঘটিয়েছে । বিপরীত পক্ষে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে ,মেয়েদের লালন পালন করা , তাদেরকে উত্তম দীক্ষা দেয়া এবং ঘর সংসারে কাজে পারদর্শী করে গড়ে তোলা অনেক বড় নেকীর কাজ । রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে মেয়েদের সম্পর্কে মানুষের সাধারণ ধারণা যেভাবে পরিবর্তন করে দেন হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে তা আন্দাজ করা যাবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমি নীচে কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করছি :


"এই মেয়েদের জন্মের মাধ্যমে যে ব্যক্তিকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয় , তারপর সে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণে পরিণত হবে। " ( বুখারী ও মুসলিম )




"যে ব্যক্তি দু'টি মেয়ের লালন পালন করে , এভাবে তারা বালেগ হয়ে যায় , সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে ঠিক এভাবে আসবে । একথা তিনি নিজের আঙুলগুলো একসাথে করে দেখান । "




" যে ব্যক্তি তিন কন্যা বা বোনের লালনপালন করে , তাদেরকে ভালো আদব কায়দা শেখায় এবং তাদের সাথে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করে , এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা তার সাহায্যের মুখাপেক্ষী না থাকে , তার জন্য আল্লাহ জান্নাত ওয়াজিব করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন : যে আল্লাহর রসূল ! আর যদি দু'জন হয় । জবাব দেন , দু'জনকে এভাবে লালন পালন করলে তাই হবে। হাদীসের বর্ণনাকারী ইবনে আব্বাস ( রা) বলেন , যদি লোকেরা সে সময় একজনের লালন পালন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো তাহলে তিনি একজনের সম্পর্কেও এই একই জবাব তিনি দিতেন। " ( শরহুস সুন্নাহ )




"যার কন্যা - সন্তান আছে , সে তাকে জীবিত কবর দেয়নি , তাকে দীনহীন ও লাঞ্ছিত করেও রাখেনি এবং পুত্রকে তার ওপর বেশী গুরুত্বও দেয়নি , আল্লাহ তাকে জান্নাতে স্থান দেবেন । " ( আবু দাউদ)




"যার তিনটি কন্যা আছে , সেজন্য সে যদি সবর করে এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী তাদেরকে ভালো কাপড় পরায় , তাহলে তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ে পরিণত হবে। " ( বুখারীর আদাবুল মুফরাদ ও ইবনে মাজাহ )


" যে মুসলমানের দু'টি মেয়ে থাকবে , সে যদি তাদেরকে ভালোভাবে রাখে , তাহলে তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। " ( ইমাম বুখারীর আদাবুল মুফরাদ )






" নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাহ ইবনে জা'শূমকে বলেন , আমি কি তোমাকে বলবো সবচেয়ে বড় সাদকাহ ( অথবা বলেন , বড় সাদকাগুলোর অন্যতম ) কি ৷ সুরাকাহ বলেন , অবশ্যই বলুন হে আল্লাহর রসূল ! তিনি বলেন তোমার সেই মেয়েটি যে ( তালাক পেয়ে অথবা বিধবা হয়ে) তোমার দিকে ফিরে আসে এবং তুমি ছাড়া তার আর কোন উপার্জনকারী থাকে না। " ( ইবনে মাজাহ ও বুখারী ফিল আদাবিল মুফরাদ)
এই শিক্ষার ফলে মেয়েদের ব্যাপারে কেবল আরবদেরই নয় দুনিয়ার অন্যান্য যেসব জাতি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সবার দৃষ্টিভংগীই বদলে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন