সাবা জাতির ইতিহাস


কুরআন মজীদে সাবা জাতির ইতিহাসের প্রতি যে ইংগিত করা হয়েছে তা অনুধাবন করতে হলে এ জাতি সম্পর্কে ইতিহাসের অন্যান্য মাধ্যম থেকে যেসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সেগুলোও সামনে থাকা প্রয়োজন।

অতি প্রাচীনকাল থেকে আরবে এ জাতির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। খৃষ্টাপূর্ব ২৫০০ অব্দে উর এর শিলালিপিতে সাবোম নামের মধ্য দিয়ে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ব্যাকিলন ও আসিরিয়ার শিলালিপিতে এবং অনুরূপভাবে বাইবেলেও ব্যাপকহারে এর উল্লেখ দেখা যায়। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন যাবুর ৭২
:১৫, যিরমিয় ৬৬: ২০,
যিহিস্কেল
২৭ : ২২ ও ৩৮ :১৩ এবং ইয়োব ৬
: ১৯) গ্রীক ও রোমীয় ঐতিহাসিকবৃন্দ এবং ভূগোলবিদগণ থিয়োফ্রষ্টিসের (খৃঃ পূঃ ২৮৮) সময় থেকে খৃস্ট পরবর্তী কয়েক শো বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে এর আলোচনা করে এসেছেন ।

প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইয়ামন থেকে প্রায় ৩ হাজার শিলালিপি উদ্ধার করা হয়েছে। এ গুলো সাবা জাতির ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করে। এই সংগে আরবীয় ঐতিহ্য ও প্রবাদ এবং গ্রীক ও রোমীয় ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যাবলী একত্র করলে এ জাতির একটি বিস্তারিত ইতিহাস লেখা যেতে পারে। এসব তথ্যাবলীর দৃষ্টিতে তার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ যুগগুলো নিন্মভাবে বিবৃত করা যেতে পারে-

দুইঃ খৃস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দ থেকে খৃস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ পর্যন্ত সময় । এ সময় সাবার বাদশাহরা মুকাররিব উপাধি ত্যাগ করে মালিক (বাদশাহ) উপাধি গ্রহণ করেন । এর অর্থ হয়,
রাজ্য
পরিচালনায়
ধর্মীয়
ভাবধারার
পরিবর্তে
রাজনীতি
ও
সেকুলারিজমের
রং
প্রাধান্য
লাভ
করেছে
।
এ
আমলে
সাবার
বাদশাহগণ
সারওয়াহ
ত্যাগ
করে
মারিবকে
তাদের
রাজধানী
নগরীতে
পরিণত
করেন
এবং
এর
অসাধারণ
উন্নতি
সাধন
করেন
।
এ
নগরটি
সাগর
থেকে
৩৯০০
ফুট
উচুতে
সানয়া
থেকে
৬০
মাইল
পূর্ব
দিকে
অবস্থিত
ছিল
।আজ পর্যন্ত এর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো সাক্ষ দিচ্ছে যে , এক সময় এটি ছিল দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুসভ্য জাতির কেন্দ্রভূমি ।

চার- ৩০০ খৃষ্টাব্দের পর থেকে ইসলামের প্রারন্তকাল পর্যন্ত সময়। এটি ছিল সাবা জাতির ধ্বংসের সময়। এ সময় তাদের মধ্যে অনবরত গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। বাইরের জাতিসমুহের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। ব্যবসা-বানিজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। কৃষি ব্যবস্থা বরবাদ হয়ে যায়। শেষে জাতীয় স্বাধীনতাও বিলোপ ঘটে। প্রথমে যাইদানী, হিময়ারী ও হামদানীদের পারস্পরিক বিরোধ ও সংঘাতের সুযোগ গ্রহণ করে ৩৪০ থেকে ৩৭৮ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত ইয়ামনে হাবশীদের রাজত্ব চলে। তারপর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার হয় ঠিকই কিন্তু মারিবের বিখ্যাত বাঁধে ফাটল দেখা দিতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত ৪৫০ বা ৪৫১ খৃষ্টাব্দে বাঁধ ভেংগে পড়ে এবং এর ফলে যে মহাপ্লাবন হয় তার উল্লেখ কুরআন মাজীদের ওপরের আয়াতে করা হয়েছে। যদিও এরপর থেকে আবরাহার সময় পর্যন্ত অনবরত বাঁধের মেরামত কাজ চলতে থাকে তবুও যে জনবসিত একবার স্থানচ্যুত হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল তা পুনরায় আর একত্র হতে পারেনি এবং পানি সেচ ও কৃষির যে ব্যবস্থা একবার বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল তার আর পুনরগঠন সম্ভবপর হয়নি। ৫২৩ খৃষ্টাব্দে ইয়ামনের ইহুদী বাদশাহ যু-নওয়াস নাজরানের খৃষ্টানদের ওপর যে জুলুম-নিপীড়ন চালায় কুরআন মজীদে আসহাবুল উত্থদুদ নামে তার উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে হাবশার (আবিসিনিয়া এবং বর্তমানে ইথিওপিয়া) খৃষ্টান শাসক ইয়ামনের ওপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালান।
তিনি সমগ্র দেশ জয় করে নেন। এরপর ইয়ামনের হাবশী গভর্নর আবরাহা কাবা শরীফের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব খতম করার এবং আরবের সমগ্র পশ্চিম এলাকাকে রোমান হাবশী প্রভাবাধীনে আনার জন্য ৫৭০ বা ৫৭১ খৃষ্টাব্দে নবী (সা)
এর
জন্মের
মাত্র
কিছুদিন
পূর্বে
মক্কা
মুআযযমা
আক্রমণ
করে।
এ
অভিযানে
তার
সমগ্র
সেনাদল
যে
ধ্বংসের
সম্মুখীন
হয়
কুরআন
মজীদে
আসহাবুল
ফীল
শিরনামে
তা
উল্লেখিত
হয়েছে।
সবশেষে
৫৭৫
খৃ
ইরানীরা
ইয়ামন
দখল
করে
৬২৮
খৃস্টাব্দে
ইরানী
গভর্ণর
বাযান
এর
ইসলাম
গ্রহণের
পর
এ
দখল
দারিত্বের
অবসান
ঘটে।

এ সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় জলধারাটি মারিব নগরীর নিকটবর্তী বালক পাহাড়ের মধ্যস্থলের উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছিল । কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ দৃষ্টি যখন তাদের ওপর থেকে সরে গেলো তখন পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ বিশাল বাঁধটি ভেঙে গেলো । এ সময় এ থেকে যে বন্যা সৃষ্টি হলো তা পথের বাঁধগুলো একের এক ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চললো, এমনকি শেষ পর্যন্ত দেশের সমগ্র পানিসেচ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলো এবং এরপর আর কোন ভাবেই এ ব্যবস্থা পুনরবহাল করা গেলো না ।
ব্যবসায়ের জন্য এ জাতিকে আল্লাহ সর্বোত্তম ভৌগলিক স্থান দান করেছিলেন। তারা এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। এক হাজার বছরের বেশী সময় পর্যন্ত এ জাতিটিই পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ব্যবসায়ের সংযোগ মাধ্যমের স্থান দখল করে থাকে। একদিকে তাদের বন্দরে চীনের রেশম, ইন্দোনেশিয়া ও মালাবারের গরম মশলা, হিন্দুস্থানের কাপড় ও তলোয়ার, পূর্ব আফ্রিকার যংগী দাস, বানর, উটপাখির পালক ও হাতির দাঁত পৌঁছে যেতো এবং অন্যদিকে তারা এ জিনিসগুলোকে মিসর ও সিরিয়ার বাজারে পৌঁছেয়ে দিত। সেখান থেকে সেগুলো গ্রীস ও রোমে চলে যেত। এ ছাড়াও তাদের নিজেদের এলাকায় ও উৎপন্ন হত লোবান, চন্দন কাঠ, আশ্বর, মিশক, মুর, কারফা, কাসবুখ, যারীরাহ, সালীখাহ ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যাদি বিপুল পরিমাণে। মিসর, সিরিয়া , গ্রীস ও রোমের লোকেরা এগুলো লুফে নিত।
দুটি বড় বড় পথে এ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চলত। একটি ছিল সমুদ্রপথ এবং অন্যটি স্থলপথ। হাজার বছর পর্যন্ত সমুদ্রপথে ব্যবসায় ছিল সাবায়ীদের একচেটিয়া দখলে। কারণ লোহিত সাগরের মৌসুমী বায়ু প্রবাহ, ভূগভস্থ পাহাড় ও নোংগর করার স্থান গুলোর গোপন তথ্য একমাত্র তারাই জানত। অন্য কোন জাতির এ ভয়াল সাগরে জাহাজ চালাবার সাহসই ছিল না। এ সামুদ্রিক পথে তারা জর্দান ও মিসরের বন্দর সমুহে নিজেদের পন্যদ্রব্য পৌছেয়ে দিত। অন্যদিকে স্থলপথ আদন (এডেন) ও হাদরামাউত থেকে মারিবে গিয়ে মিশত এবং তারপর আবার সেখান থেকে একটি রাজপথ মক্কা, জেদ্দা, ইয়াসরিব, আলউলা, তাবুক ও আইলা হয়ে পেট্টা পর্যন্ত পৌছে যেত।
এরপর একটি পথ মিসরের দিকে এবং অন্য পথটি সিরিয়ার দিকে যেত। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, এ স্থলপথে ইয়ামন থেকে সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে সাবায়ীদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তাদের বানিজ্য কাফেলা দিনরাত এ পথে যাওয়া আসা করত। এ উপনবেশগুলোর মধ্যে অনেক গুলোর ধ্বংসাবশেষ এ এলাকায় আজো রয়ে গেছে এবং সেখানে সাবায়ী ও হিময়ারী ভাষায় লিখিত শিলালিপি পাওয়া যাচ্ছে।

এ খালের মাধ্যমে মিসরের নৌবহর প্রথমবার লোহিত সাগরে প্রবেশ করে কিন্তু সাবায়ীদের মোকাবিলায় এ প্রচেষ্টা বেশী কার্যকর প্রমাণিত হতে পারেনি ।তারপর
রোমানরা
যখন
মিসর
দখল
করে
তখন
তারা
লোহিত
সাগরে
অধিকতর
শক্তিশালী
বাণিজ্য
বহর
নিয়ে
আসে
এবং
তার
পশ্চাতভাগে
একটি
নৌবাহিনীও
জুড়ে
দেয়
।
এ
শক্তির
মোকাবিলা
করার
ক্ষমতা
সাবায়ীদের
ছিল
না
।
রোমানরা
বিভিন্ন
বন্দরে
নিজেদের
ব্যবসায়িক
উপনিবেশ
গড়ে
তোলে
সেখানে
জাহাজের
প্রয়োজন
পূর্ণ
করার
ব্যবস্থা
করে
।
যেখানে
সম্ভব
হয়
সেখানে
নিজেদের
সামরিক
বাহিনীও
রেখে
দেয়
।
শেষ
পর্যন্ত
এমন
এক
সময়
আসে
যখন
এডেনের
ওপর
রোমানদের
সামরিক
আধিপত্য
প্রতিষ্ঠিত
হয়
।
এ
সুযোগে
রোমান
ও
হাবশী
শাসকরা
সাবায়ীদের
মোকাবিলায়
সম্মিলিতভাবে
চক্রান্ত
করে
।
এর
ফলে
শেষ
পর্যন্ত
এ
জাতির
স্বাধীনতা
সূর্যও
অস্তমিত
হয়
।

নৌবাণিজ্য বেদখল হয়ে যাবার পর সাবায়ীদের হাতে থেকে যায় শুধুমাত্র স্থলপথের বানিজ্য। কিন্তু নানাবিধ কারণ ধীরে ধীরে তারও কোমর ভেংগে যায়। প্রথমে নাবতীরা পেট্টা থেকে নিয়ে আল'উলা পর্যন্ত হিজায ও জর্দানের উচ্চ ভূমির সমস্ত উপনিবেশ থেকে সাবায়ীদেরকে বের করে দেয়। তারপর ১০৬ খৃ রোমানরা নাবতী রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে হিজাযের সীমান্ত পর্যন্ত সিরিয়া ও জর্দানের সমস্ত এলাকা নিজেদর শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। এরপর হাবশা ও রোম সাবায়ীদের পারস্পরিক সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যবসাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেবার জন্য সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ কারণে হাবশীরা বারবার ইয়ামনের ব্যাপারে নাক গলাতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সারা দেশ অধিকার করে নেয়।

আল্লাহর অনুগ্রহ যতদিন তাদের সহযোগী ছিল ততদিন এসব কিছু ছিল। শেষে যখন তারা চরমভাবে অনুগ্রহ অস্বীকার করার এবং নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবার পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন মহান সর্বশক্তিমান রবের অনুগ্রহ দৃষ্টি তাদের ওপর থেকে চিরকালের জন্য সরে যায় এবং তাদের নাম নিশানা পর্যন্তও মুছে যায়।
তথ্যবহুল ইসলামী লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনলিখেছেন তো ভালই কিন্তু রেফারেন্স দিয়ে দিলে কথাটার জোর বাড়ত। বিশ্বাসে অনেকে দ্বিধাবোধ করবে।
উত্তরমুছুনযাই হোক ভালো ছিল।