শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১২

মসজিদ –ই-"দ্বিরার" (ক্ষতিকর) বা ক্ষতিকর মসজিদের কাহিনী


মসজিদ –ই-"দ্বিরার" (ক্ষতিকর) বা ক্ষতিকর মসজিদের কাহিনী


নবী (সা) মদীনায় আগমনের আগে খাযরাজ গোত্রে আবু আমের নামে এক ব্যক্তি ছিল। জাহেলী যুগে সে খৃষ্টান রাহেবের (সাধু) মর্যাদা লাভ করেছিল। তাকে আহলে কিতাবদের আলেমদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তি গণ্য করা হতো।অন্যদিকে সাধুগিরির কারণে পণ্ডতি সুলভ মর্যাদার পাশাপাশি তার দরবেশীর প্রভাবও মদীনা ও আশেপাশের এলাকার অশিক্ষিত আরব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। নবী (সা) যখন মদীনায় পৌছলেন তখন সেখানে বিরাজ করছিল আবু আমেরের ধর্মীয় ও আধ্যত্মিক কতৃত্বের রমরমা অবস্থা। কিন্তু এ জ্ঞান ,বিদ্যাবত্তা ও দরবেশী তার মধ্যে সত্যানুসন্ধিসা ও সত্যকে চেনার মতো ক্ষমতা সৃষ্টি করার পরিবর্তে উল্টো তার জন্য একটি বিরাট অন্তরাল সৃষ্টি করলো। আর এ অন্তরাল সৃষ্টির ফলে রসূলের আগমণের পর সে নিজে ঈমানের নিয়ামত থেকে শুধু বঞ্চিতই রইল না । বরং রসূলকে নিজের ধর্মীয় পৌরহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বি এবং নিজের দরবেশী ও সাধু বৃত্তিক কর্মকাণ্ডের শত্রু মনে করে তার ও তার সমুদয় কার্যক্রমের বিরোধিতায নেমে পড়লো। প্রথম দুবছর তার আশা ছিল কুরাইশী কাফেরদের শক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হবে। কিন্তু বদরের যুদ্ধে কুরাইশরা চরমভাবে পরাজিত হলো। এ অবস্থায় সে আর নীরব থাকতে পারলো না। সেই বছরই সে মদীনা থেকে বের হয়ে পড়লো। সে কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্রের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করলো। যেসব কুচক্রীর চক্রান্ত ও যোগসাজশে ওহোদ যুদ্ধ বাধে, তাদের মধ্যে এ আবু আমেরও অন্যমত। বলা হয়ে থাকে, ওহোদের যুদ্ধের ময়দানে সে অনেকগুলো গর্ত খুঁড়েছিল। এরই একটির মধ্যে পড়ে গিয়ে নবী (সা) আহত হয়েছিলেন। তারপর আহযাব যুদ্ধের সময় চারদিকে থেকে যে সেনাবাহী মদীনার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল তাকে আক্রমণে উস্কে দেয়ার ব্যাপারেও তার অগ্রনী ভুমিকা ছিল। এরপর হুনাইন যুদ্ধ পর্যন্ত আরব মুশরিকও মুসলমানদের মধ্যে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে সবগুলোতেই এ ঈসায়ী দরবেশ ইসলামের বিরুদ্ধে মুশরিক শক্তির সক্রিয় সহয়ক ছিল। শেষ পর্যন্ত আরবের কোন শক্তি ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে পারবে বলে তার আর আশা রইল না। কাজেই সে আরব দেশ ত্যাগ করে রোমে চলে যায় এবং আরব থেকে যে "বিপদ" মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে সে কাইসাকে (সীজার )অবহিত করে। এ সময়ই মদীনায় খবর পৌছে যে, কাইসার আরব আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এরই প্রতিবিধান করার জন্য নবী (সা) কে তাবুক অভিযান করতে হয়।
 
ঈসায়ী রাহেব আবু আমেরের এ ষড়যন্ত্রমূলক তপরতায় তার সাথে শরীক ছিল মদীনার মুনাফিক গোষ্ঠির একটি দল। আবু আমেরকে তার ধর্মীয় প্রভাব ব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে রোমের কাইসার ও উত্তরাঞ্চলের খৃষ্টান আরব রাজ্যগুলোর সামরিক সাহায্য লাভ করতেও এ মুনাঠিকরা তাকে পরামর্শ দেয় ও মদদ যোগায়। যখন সে রুমের পথে রওয়ানা হচ্ছিল তখন তার ও এ মুনাফিকদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হলো। এ চুক্তি অনুযায়ী স্থির হলো, যে মদীনায় তারা নিজেদের একটি পৃথক মসজিদ তৈরী করে নেবে। এভাবে সাধারণ মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়ে মুনাফিক মুসলমানদের এমন একটি স্বতন্ত্র জোট গড়ে উঠবে যা ধর্মীয় আলখেল্লায় আবৃত থাকবে। তার প্রতি সহজে কোন প্রকার সন্দেহ করা যাবে না। সেখানে শুধু যে, মুনাফিকরাই সংঘটিত হবে এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারনের জন্য পরামর্শ করবে তা নয়।বরং আবু আমেরের কাছ থেকে যেসব এজেন্ট খবর ও নির্দেশ নিয়ে আসবে তারাও সন্দেহের উর্ধে থেকে নিরীহ ফকীর ও মুসাফিরের বেশে এ মসজিদে অবস্থান করতে থাকবে। এ ন্যাক্করজনক ষড়যন্ত্রটির ভিত্তিতেই এ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল এবং এরি কথা এ আয়াতে বলা হয়েছে।

মদীনায় এ সময় 
দুটি মসজিদ ছিল। একটি মসজিদে কুবা। এটি ছিল নগর উপকণ্ঠে। অন্যটি ছিল মসজিদে নববী। শহরের অভ্যন্তরে ছিল এর অবস্থান। এ দুটি মসজিদ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় একটি মসজিদ নির্মাণ করার কোন প্রয়োজনই ছিল না। আর এটা কোন যুক্তিহীন ধর্মীয় আবেগের যুগ ছিল না যে, প্রয়োজন থাকুক ব না থাকুক মসজিদ নামে নিছক একটি ইমারত তৈরী করে দিলেই তখন নেকীর কাজ বলে মনে করা হবে।বরং একটি নতুন মসজিদ তৈরী করার অর্থই ছিল মুসলমানদের জামায়াতের মধ্যে অনর্থক বিভেদ সৃষ্টি করা। একটি সত্যনিষ্ঠা ইসলামী ব্যবস্থা কোনক্রমেই এটা বরদাশত করতে পারে না। তাই তারা নিজেদের পৃথক মসজিত তৈরী কারার আগে তার প্রয়োজনের বৈধতা, প্রমাণ করতে বাধ্য ছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা নবী (সা) এর সামনে এ নতুন নির্মাণ কাজের প্রয়োজন পেশ করে। এ প্রসঙ্গে তারা বলে, বৃষ্টি বাদলের জন্য এবং শীতের রাতে সাধারণ লোকদের বিশেষ করে উল্লেখিত দুটি মসজিদ থেকে দুরে অবস্থানকারী বৃদ্ধ, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের প্রতিদিন পাঁচবার মসজিদে হাজিরা দেয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । কাজেই আমরা শুধুমাত্র নামাযীদের সুবিধার্থে এ নতুন মসজিদটি নির্মাণ করতে চাই।

মুখেএ পবিত্র ও কল্যাণমূসক বাসনার কথা উচ্চারণ করে যখন এ "দ্বিরার", (ক্ষতিকর) মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হলো তখন এ দুর্বৃত্তরা নবী (সা) এর দরবারে হাযির হলো এবং সেখানে একবার নামায পরিয়ে মসজিদটির উদ্বোধন করার জন্য তার কাছে আবেদন জানালো। কিন্তু আমি এখন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আছি এবং শীঘ্রই আমাকে একটি বড় অভিযানে বের হতে হবে, সেখান থেকে ফিরে এসে দেখা যাবে, একথা বলে তিনি তাদের আবেদন এড়িয়ে গেলেন। এরপর তিনি তাবুক রওয়ানা হয়ে গেলেন এবং তার রওয়ানা হওয়ার পর এ মুনাফিকরা এ মসজিদে নিজেদের জোট গড়ে তূলতে এবং ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো।






এমন কি তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, ওদিকে রোমানদের হাতে মুসলমানদের মুলোপাটনের সাথে সাথেই এদিকে এরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মাথায় রাজ মূকূট পরিয়ে দেবে। কিন্তু তবুকের যা ঘটলো তাতে তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়লো। ফেরার পথে নবী (সা) যখন মদীনার নিকটবর্তী "যী আওয়ান" নামক স্থানে পৌছলেন তখন এ আয়াত নাযিল হলো। তিনি তখনই কয়েকজন লোককে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদেরকে দায়িত্ব দিলেন ,তার মদীনায় পৌছার আগেই যেন তারা দ্বিরার মসজিদটি ভেংগে ধুলিস্মাত করে দেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন